কবীর রানা'র মেয়াদোত্তীর্ণ নিরাপত্তাসমূহ গল্পের বই সম্পর্কে সাফওয়ান আমিনের রিভিউ

কবীর রানা'র মেয়াদোত্তীর্ণ নিরাপত্তাসমূহ গল্পের বই সম্পর্কে সাফওয়ান আমিনের রিভিউ


সেদিন কবীর রানা স্যারের "মেয়াদোত্তীর্ণ নিরাপত্তাসমূহ" গল্পের বইটা হঠাৎ হাত দিয়ে ছুঁয়ে পড়া শুরু করেছিলাম। "মেয়াদোত্তীর্ণ নিরাপত্তাসমূহ" গল্পটা পড়তে এমন কাব্যিক ধাক্কা খাবো, ভাবিনি। গল্পের বুনন এমন যে, সহজে একজন পাঠক জিস্ট গল্পটা হয়তো ধরতে পারবে না। মানে গল্পের সারাংশে পৌঁছানো একটু কঠিন হবে হয়তো। কিন্তু স্যারের যে বলার ধরণ, তা আগে থেকে অবগত থাকার কারণে পড়তে পড়তে আগানো শুরু করলাম। তারপর আমার মন্তব্য হচ্ছে অসাধারণ। শুধু এই একটা গল্পকেই ৩০/৪০ পৃষ্ঠার ব্যাখ্যা দাড় করালেও বলা বাকিই থেকে যাবে বোধহয়। এত হিউজ একটা টপিকের এই গল্পটা। গল্পটা পড়ার ফিলিংসটা এমন হচ্ছিল যে, এইটা কারো কাছে ব্যাখ্যা করে বলতে না পারলে আমার আত্মতৃপ্ত হচ্ছিল না। সেই সুযোগ অবশ্য পরের দিন সকাল সকাল হয়ে গেল। সেদিন সকালে আমার রুমে আসলেন কবি জীবন সাহা  ও কবি মাহমুদ কাওছার। তাদের পেয়ে আমার পড়ার অনুভূতি শুনিয়ে দিলাম। ভালো কোনো গল্প পড়ার পর, তার অনুভূতিটা কাউকে জানানো, এ এক আত্মতৃপ্তির ব্যাপার।

২.
গল্পটা শুরু এভাবে "বিষ জমে, চাঁদ জমে রাতের ডগায়। বিষটুকু পাহারা দেওয়ার কথা ভেবে, সেউজগাড়ি মহল্লার অধিবাসীদের অতি অস্থিরতায় চাঁদ ভুলে যায়।" গল্পটার গড়ে উঠেছে এই সেউজগাড়ি মহল্লাকে ঘিরে। আসলেই কি তাই? সেউজগাড়ি মহল্লা কি শুধুই সেউজগাড়ি মহল্লা? নাকি এই বগুড়া শহর? নাকি এই বাংলাদেশ? নাকি গোটা বিশ্বের সামাজিক অবস্থা?

যতদূর জানি, কবীর রানা স্যার নিজেও এই সেউজগাড়ি মহল্লার অধিবাসীদেরই একজন ছিলেন। হয়তো গল্পটা তখন লেখা। অথবা পরে কখনো এসে লেখা। যা হোক, প্রসঙ সেটা নয়, প্রসঙ্গ হলো, তিনি কিভাবে ভাবেন? তিনি কিভাবে এই কঠিন কাজকে গল্পে এনে সহজে রূপ দিলেন?

মানে তাঁর গল্পের বিষয়বস্তু একটা বিমূর্ত ভাব। মানে তিনি ডিল করেছেন, সেউজগাড়ি মহল্লার মানুষের মানসিক অবসাদ, মানসিক অতৃপ্তি নিয়ে।

আর মানসিক অতৃপ্তিকে তিনি "ঘুম ও বিষ" শব্দদ্বয় দ্বারা উপস্থাপনের প্রয়াস দেখিয়েছে। এই ঘুম ও বিষ শব্দকে ভাঙতে গেলে যে, কত হাজার রকম দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব আল্লাহই ভালো জানে!

গোটা গল্পে সেই অতৃপ্তিকে দূর করার কথাই গল্পে গল্পে বলে গেছে, কাহিনির বিন্যাসের ভিতর দিয়ে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সমাধান দেননি। এটাই উচিত, কেননা, সমাধান দেওয়া তো সাহিত্যিকের কাজ নয়। স্যারের গল্পের শেষটা যেন শুরুতে ফিরিয়ে আনে। এ জন্য গল্পটাকে আরও চমকপ্রদ মনে হয়েছে।

৩.
গল্পের সারাংশটা আমার ঢঙে, সহজ করে একটু বলি, এতে সহজে আলাপটা আলাপযোগ্য মনে হবে!
::
তো সেউজগাড়ি মহল্লার মানুষের রাত এক আতংকের নাম। তারা রাতকে ভয় পায়। তাই তাদের রাতের নিরাপত্তা চাই। মহল্লাবাসীদের বিষ রক্ষার জন্য, ঘুম রক্ষার জন্য দু'জন নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। নিরাপত্তাকর্মীদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য তারা রাত পাহারা দেয় বাঁশি বাজিয়ে। এতে মহল্লার সবাই নিশ্চিতে ঘুমায়। জানে যে, বাঁশি বাজছে, পাহারা হচ্ছে রাতের। রাত পাহারা দেওয়ার অর্থ তাদের ঘুম ও বিষ পাহারা দেওয়া।

রাতের সে বাঁশি শুনে মহল্লার বালকদের ফুটবল মাঠের কথা মনে পড়ে। বাঁশি শুনে মহল্লার তরুণদের প্রেম সংগ্রহের ইচ্ছা জাগে। বাঁশি শুনে ওদের কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে।

অর্থাৎ বাঁশি শুনে তাদের মনের ভয় দূর হলে তারা সুখ অনুভব করে। ভয় থাকে না, ভয় দূর হয়। আর ভয় দূর হলে মানুষ উৎসবে মাততে চায়। শখের জাগরণ ঘটে। তাই বাঁশি বাজে। তরুণীরা শাড়ি পরার চেষ্টা করে। শাড়ি পরার কৌশল শেখার চেষ্টা করে। কিন্তু ওদের তো নিজস্ব কোনো শাড়ি নেই। মায়েদের দাদিদের, নানিদের শাড়িগুলো অধিকার করতে চায়। অথাৎ এই সমাজ, রাষ্ট্র এতটা মূঢ়তায় চলে গেছে যে, ভুলতে বসেছে নিজের ঐতিহ্যকে। এই জেনারেশন এখন ধারণ করে মর্ডান কালচারকে। অথচ পুরোনো ঐতিহ্য মানে সাবলীল সুখকে আলিঙ্গন করা।

এই সুখ সুখ অনুভূতিও শেষ হয়, একদিনের তুমুল বৃষ্টিতে। এই বৃষ্টিতে বালকদের দল দেখে, ওদের ফুটবল ভেসে চলে যাচ্ছে। তরূণদের দল দেখে, ওদের প্রেম ভেসে যাচ্ছে। তরূণদের দল দেখে, ওদের শাড়ি ভেসে যাচ্ছে। তারপর বৃষ্টি থেমে গেলে, পড়ে থাকতে দেখা যায়, মৃত ফুটবল, মৃত প্রেম, মৃত শাড়ি। এভাবে ওদের সুখও শেষ হয়।

তারপর আবার দুশ্চিন্তার দেখা দেয় মহল্লায়।নজরুলের মুদির দোকানের সামনে আলোচনা বসে। যে মুদির দোকান সেউজগাড়ি মহল্লার তথ্যকেন্দ্র। এ মহল্লার সকল তথ্য, সবার তথ্য এখানে জানা যায়। আলোচনা হয়, কীভাবে হারিয়ে যাওয়া ঘুম ও বিষ পুনরুদ্ধার করা যায় সে বিষয়ে।

সে সময় রাত পাহারাদার দুজন আসে। রাত পাহারা কেমন চলছে জিজ্ঞেস করলে ওদের, ওরা বলে, তারা জানায় কাঁধের পেঁচা দু'টো জানে, রাত কতটুকু নিরাপদ অবস্থায় আছে। পেঁচারা রাতের ভাষা বোঝে। তারা পেঁচার ভাষা বোঝে। আর তাদের বাঁশি তাদের ভাষা মান্য করে। ওদের জিজ্ঞেস করে হলো, কীভাবে হারিয়ে যাওয়া ঘুম ও বিষ পুনরুদ্ধার করা যায়? ওরা বলে একজন চিকিৎসক আছে, সে পুনরুদ্ধার করতে পারে হারিয়ে যাওয়া ঘুম ও বিষ। সেই চিকিৎসককে নিয়োগ দেওয়া হয়। চিকিৎসাবীদ রওশন জানায় নারীর পোশাক নারীর জন্য একটা ওষুধ। শিশুদের সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে সে সঠিক মাত্রার ঘুম ও বিষ সংরক্ষণ করতে চায়। সবাই তার চিন্তার সঙ্গে এক মত হয়। সে ধানের গল্প বলে, ধানবীজ সংরক্ষণের গল্প বলে। সে বলে, বীজেই আছে সকল ভবিষ্যৎ। প্রতিটি ভালো বীজে জমা থাকে সঠিক মাত্রার ঘুম ও সঠিক মাত্রার বিষ। শিশুরা তো বীজ।

হঠাৎ একদিন রওশন আলীর ক্লিনিকে অনেক পুলিশ। শিশুরা নাকি হারিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যালয়ে শিশুশূন্যতা, মাঠে শিশুশূন্যতা। শিশুরা কোথায়? শিশুদের সন্ধানে পুলিশ ব্যর্থ হলে গত রাতে তাদের দেখা হয় এক দিদার নামক ফকিরের সঙ্গে। দিদার ফকিরের চুল থেকে বের হওয়া সময় তারা একটা গল্প অনুসরণ করে পৌঁছে যায় শিশু সমাধিক্ষেত্রে। তারা ঘুম হারিয়ে বিষ হারিয়ে গড়াতে গড়াতে চলে গেছে সমাধিক্ষেত্রে। যদিও পুলিশ বোঝে না ঘুম হারালে, বিষ হারালে কেন শিশুরা কংকাল হয়ে সমাধির ক্ষেত্রে যায়। জানবেইবা কি করে? এই মর্ডান সোসাইটির মানুষদের জীবনে যে সুখ নেই, কিন্তু তারা জানেও না, কেন সুখ নেই তাদের! তারা জানে না, এই অসুখ কেন জেনারেশনের পর জেনারেশন ধরে ছড়িয়ে পড়ছে। আহা জানেও না যে, সভ্যতা তাদের আধুনিকতা নামে দিয়েছে অসুখ।

রওশন আলীর সনদ নকল প্রমাণিত হলে, সেউজগাড়ির মানুষেরা তাকে ঘুমচোর, বিষচোর বলে। সনদ নকল প্রমাণিত হওয়ার পর এখন রওশন আলীর বিবেচনা ও আদেশ এই যে, সেউজগাড়ির সবাইকে প্রমাণ করতে হবে, তাদের নিজের আসল সনদপত্র আছে!

সেউজগাড়ির সবাই মোমবাতি নিয়ে নিজ নিজ বনে যায়। নিজ নিজ বৃক্ষের শিকড় খুলে নিজ নিজ আয়নার সামনে দাঁড়ায়। তারপর টের পায় তাদের সকল সনদ মেয়াদোত্তীর্ণ। তার পিছনে রেখে এসেছে তাদের সুখ। তারা পিছনে রেখে এসেছে তাদের ঐতিহ্য। তারা সভ্যতার দৌড়ে কেবল নিজেকে বিকিয়ে দিয়েছে। সুখ খুঁজতে খুঁজতে এরা সুখকেই পিছনে ফেলে এসেছে। এরা নিজের জন্য রাখা সময়কে সভ্যতার হাতে তুলে দিয়েছে। তার ফল জোটা জেনারেশন ধরে এই বিষের যন্ত্রণায় ভুগছে। তাই জন্মের শুরু থেকেই শিশুরা এর যন্ত্রণায়, তরুণেরা ধুঁকছে, প্রাপ্তরা হারিয়ে খুঁজছে নিজেদেরকে।

৪.
জগতের সকল বিষয়ই তো আমার কেন জানি অমীমাংসিত মনে হয়। সমাধানহীনতাই জেনো, জগতের চরম সত্য। গল্পে গল্পে বলা এই অসুখের কি কোনো সমাধান আছে? আপনি জানেন? গল্পকারও এর সমাধান দেননি। ফিরে গেছে শুরুতে। 


শেষ প্যারা এমন করে লেখা,

বাঁশি বাজে। সেউজগাড়ির রাত, ঘুম, বিষ পাহারা দিচ্ছে দুজন বামন, দুটা পেঁচা, দুটা বাঁশি। দিদার ফকিরের চুল রাতের সমান দীর্ঘ হলে ঠকঠক করে লাঠি হাতে তাদের পিছনে পিছনে আছে দিদার ফকির।


এই যে সমাধানহীনতার মাঝে একই অসুখে বারবার বারবার চক্রাকারে ঘুরছে ভাঁওতাবাজির এই বিলাসী সমাজ ও সভ্যতা, তার থেকে রক্ষা পাবে মানুষ? পাবে না, কেননা সেই মডার্ন সোসাইটির সবাই হিপোক্রেট। গল্পের পাহারাদার, ও রওশনসহ প্রতিটি চরিত্র যেমন হিপোক্রেট, তেমনই বাস্তব জগতের সবাইও একেকটা হিপোক্রেট। জগতের ভালো করতে এসেই মানুষ হিপোক্রেসিতে লিপ্ত হয়। এই তো স্বভাব মডার্ন মানুষ তোমার!

তো এই সমস্যার সমাধান রয়েছে?

ছোট থেকেই তো শিশুরা শেখে তার স্বভাব ও প্রকৃতি সমাজ, পরিবেশ ও পরিস্থিতি থেকে। মন্দ শিখলে মন্দ থাকে। আর এমন সময়ে আছি আমরা মন্দ শেখা ছাড়া কোনো উপায়ও নাই। শেষ পর্যন্ত আমরা অসুখে চক্রাকারে ঘুরতে থাকি। তাই গল্পকারও থেকে গেছে সমাধানহীন।

অমর একুশে বইমেলা ২০২৪-এ “কেউ মরছে না” উপন্যাসটি পাওয়া যাচ্ছে দেশ পাবলিকেশন্সের স্টলে। প্রচ্ছদ বিধান সাহা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ