সেরিনা জাহান রচিত "ধূসর মস্কো" বইয়ের পাঠ প্রতিক্রিয়া | তানভীর ইসলাম

সেরিনা জাহান রচিত "ধূসর মস্কো"


এই সপ্তাহে সেমিস্টারের স্প্রিং ব্রেক চলছে। এরই ফাঁকে Mashroof Hossain এর সৌজন্যে পড়া হলো সেরিনা জাহানের লেখা বই 'ধূসর মস্কো'। লেখিকা ১৯৮৭ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ছয় বছর মস্কোর প্যাট্রিস লুমুম্বা পিপলস ফ্রেন্ডশিপ বিশ্ববিদ্যালয়ে (এখন নাম পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি অফ রাশিয়া) সাংবাদিকতায় স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষালাভের জন্য সেখানে বসবাস করেছিলেন। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙনের একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণের এই সময়কাল নিয়ে রচনা করেছেন তাঁর প্রথম গ্রন্থ 'ধূসর মস্কো'। বইটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছে ১৯৯৬ সালে।

লেখিকা যখন ১৯৮৭ সালে মস্কো পৌঁছেছিলেন, তার কিছু আগেই সোভিয়েত ইউনিয়নের পট পরিবর্তন শুরু হয়েছিলো। মিখাইল গর্বাচেভ ১৯৮৬ সালে গ্লাসনস্ত, পেরিস্ত্রোইকা নীতি গ্রহণের পর থেকেই আমরা দেশের পত্রিকায় এই শব্দ দু'টো ঐসময় নিয়মিত দেখে এসেছি, যদিও তখন অর্থ ঠিকমতো বুঝিনি। মনে পড়ছে, গ্লাসনস্তকে তখন মজা করে বলতাম গ্লাস নষ্ট। রুশ-বাংলা অভিধানে এর অর্থ লেখা আছে 'প্রকাশ বা প্রচার করা'। আসলে অর্থ 'বাকস্বাধীনতা'। আর পেরিস্ত্রোইকা অর্থ 'পুনর্গঠন' বা 'পুননির্মাণ'। বইটি শুরুই হয়েছে 'নতুন কয়েকটি শব্দ' এই অধ্যায়ের মাধ্যমে যেখানে সেরিনা জাহান বিস্তারিত ব্যাখা করেছেন এই শব্দগুলোর মানে আসলে কী এবং মস্কো গিয়ে তিনি কীভাবে এই শব্দগুলোর প্রয়োগ হতে দেখেছিলেন। গ্লাসনস্ত আর পেরিস্ত্রোইকা যে 'স্তালিনবাদ' শব্দের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং স্ট্যালিন যে গর্বাচেভ আমলে (পরবর্তীতে ইয়েলেৎসিনের রাশিয়ায়) প্রচণ্ড ঘৃণিত ছিলেন, যার বাড়ি ছিলো আসলে জর্জিয়া প্রদেশে- তা এই বইয়ের মাধ্যমে জানা হলো।  

মোটা দাগে, রুশ বা অক্টোবর বিপ্লবে জার সাম্রাজ্য উৎখাত করে মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি ইউরোপের ১৫টি রাজ্য একত্র করে 'ইউনিয়ন অফ সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক' (USSR) গঠনের মাধ্যমে যে মার্কসবাদী সমাজতন্ত্র কায়েমের চেষ্টা করেছিলো, তা জোসেফ স্ট্যালিনের সময় থেকে মূলত তার একনায়কত্ব ও স্বৈরতান্ত্রিক (টোটালিটারিয়ান ডিক্টেটরশিপ) রাষ্ট্রপরিচালনার ফলে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এই রাজ্যগুলোর মধ্যে অসন্তোষ ও বিভেদ শুরু হয়, যা পরবর্তীতে দীর্ঘদিন শক্ত হাতে দমন করা হলেও গর্বাচেভের নেয়া গ্লাসনস্ত ও পেরিস্ত্রোইকা নীতি গ্রহণের ফলে আর ধামাচাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। সেরিনা জাহানের বিশ্ববিদ্যালয় মস্কোতে অবস্থিত হলেও, ছুটিতে শিক্ষাসফরে তিনি চষে বেড়িয়েছেন জর্জিয়া, ইউক্রেন, লাটভিয়া নানা প্রদেশে এবং বইতে তুলে এনেছেন এই বিভাজন নিয়ে সেখানকার মানুষের মনোভাব। গ্লাসনস্ত বা বাকস্বাধীনতা যে কত মূল্যবান সেটা উঠে এসেছে যখন সেরিনা তাদের প্রশ্ন করেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন টুকরো হয়ে আলাদা হলে তোমরা কি ভালো থাকবে? এই মানুষগুলো বলেছে, তারা হয়তো এখনকার মতোই থাকবে, কিন্তু তারা যে ভালো নেই সেটা অন্তত বলতে পারবে! মানুষ কতটা নিষ্পেষিত হলে শুধু 'ভালো নেই' এইটুকু স্বাধীনভাবে বলার জন্য স্বাধীন হতে চায়!    

'ধূসর মস্কো' বইয়ে আমার সবচেয়ে প্রিয় অধ্যায় 'রবীন্দ্রনাথ, অরওয়েল, শেভচেঙ্কো...রাশিয়া' যেখানে লেখিকা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা 'রাশিয়ার চিঠি', জর্জ অরওয়েলের '১৯৮৪' এবং আর্কাদি নিকোলায়েভিচ শেভচেঙ্কোর আত্মজীবনী 'ব্রেকিং উইথ মস্কো' বিশ্লেষণ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের তিনটি ভিন্ন সময়ের রূপরেখা উপস্থাপন করেছেন, যা এই ভাঙনের একটা ক্রমপঞ্জি বা সামগ্রিক চিত্র পাঠকের সামনে তুলে ধরে। রবীন্দ্রনাথ 'রাশিয়ার চিঠি' লিখেছিলেন স্ট্যালিনের আমলে যখন ১৯৩০ এর সেপ্টেম্বরে দিন পনেরোর জন্য মস্কোতে ছিলেন। সংক্ষিপ্ত সেই সফরে বিপ্লবোত্তর রাশিয়াকে দেখে গভীরভাবে আপ্লুত হলেও সবকিছু এক ছাঁচে ঢেকে ফেলার যে গলদ সেটা তাঁর চোখে পড়েছিলো। জর্জ অরওয়েল তাঁর বিখ্যাত ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস 'নাইনটিন এইটি ফোর' লিখেছিলেন ১৯৪৯ সালে স্ট্যালিন যখন তার ক্ষমতার শীর্ষে। ডেমোক্রেটিক সোস্যালিজমে বিশ্বাসী অরওয়েল স্ট্যালিনীয় মডেলকে সমাজতন্ত্রের কুৎসিততম ও বিকৃত রূপ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। অরওয়েলের ১৯৮৪তে 'বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ' অবশ্য আমাদের ক্ষেত্রবিশেষে আমেরিকার কথাও মনে করিয়ে দেয়। স্ট্যালিনের পর ক্ষমতায় এসেছে খ্রুশ্চেভ ও ব্রেজনেভ। স্ট্যালিন আমলের নানা অসঙ্গতি ও লোমহর্ষক অত্যাচারের কাহিনি এরা ফাঁস করে দিলেও স্ট্যালিনীয় স্ট্যাটাস ক্যু এদের আমলেও বজায় ছিলো, যার বিবরণ এই আমলের জাতিসংঘের কূটনীতিক শেভচেঙ্কোর  'ব্রেকিং উইথ মস্কো'তে পাওয়া যায়। এরই ধারাবাহিকতায় সেরিনা জাহানের বইতে আমরা পাই কীভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন গর্বাচেভের আমলে ১৫ টুকরো হয়ে গিয়েছিলো। গ্লাসনস্ত ও পেরিস্ত্রোইকা স্ট্যালিনের রেখে যাওয়া সোভিয়েত কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছিলো।

বইয়ের শেষ অধ্যায় 'ধূসর মস্কোতে' সেরিনা জাহান লিপিবদ্ধ করেছেন ভাঙনের দিনগুলোর বিভীষিকা। একদা 'সুপার পাওয়ার' স্বীকৃতি পাওয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোতে তখন খাদ্য ও অর্থের জন্য হাহাকার। যে বৃদ্ধ সারাজীবন ধরে কষ্ট করে ১০ হাজার রুবল সঞ্চয় করেছেন, মুদ্রাস্ফীতিতে তার মূল্য এসে দাঁড়িয়েছে তখন মাত্র দুই মার্কিন ডলার! ডলারের জন্য সোভিয়েত তরুণীরা বিদেশীদের কাছে শরীর বিকিয়ে দিচ্ছে, চোরাকারবারি হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান ব্যবসা, এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সোভিয়েত ডিগ্রিও বিক্রি হচ্ছে ডলারে! পাশ্চাত্যের গণমাধ্যম মস্কো এসে তুলে ধরছে সোভিয়েত ইউনিয়ন কত খারাপ ছিলো, কী খারাপ অবস্থা এখন তাদের! মিডিয়াতে দেখে নাগরিকরাও ভাবছে আসলেই তো আমরা কত খারাপ ছিলাম, আমাদের অবস্থা এতো খারাপ! এ এক বিচিত্র মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা!
 
লেখিকা সেরিনা জাহান বইটি উৎসর্গ করেছেন মস্কোর ৬ বছরের দিনগুলো, সেখানকার গ্রীষ্মের নীল আকাশ, বার্চগাছ আর মহামতি লেনিনকে। 'ধূসর মস্কো' সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ দিনগুলো নিয়ে শুধু ইতিহাস ও তথ্যের ভাণ্ডারই নয়, বইটি পড়ার সময় এর পরতে পরতে দেশটির প্রতি লেখিকার মমতা ও বেদনাও চোখে পড়বে। আমরা যারা দার্শনিক কার্ল মার্কসের লেখার ভক্ত, মার্কসবাদ প্রতিষ্ঠায় কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের বীরত্বগাঁথা যাদের বিপ্লব স্পন্দিত বুকে আজো শিহরণ জাগায়; তারা যে কেউই লেখিকার সাথে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চারণভূমি সোভিয়েত ইউনিয়নের এই ভাঙনের বয়ান পড়ে ব্যথিত হবেন। ব্যথা আরো বেশি বেজেছে এটা জেনে- লেখিকা সেরিনা জাহানও মাত্র ৪৪ বছর বয়সে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে লোকান্তরিত হয়েছেন। নইলে তাঁর হাত দিয়ে আমরা হয়তো আরও দারুণ কিছু বই পেতাম। হয়তো তাঁর ফেলে যাওয়া ধূসর মস্কোতে পুতিন নামক আরেক যে স্বৈরাচারী একনায়কের আবির্ভাব হয়েছে, যার কিছুটা ইঙ্গিত তিনি বইতে দিয়ে গেছেন- সেটা নিয়ে দুর্দান্ত আরেকটি খণ্ড রচিত হতো। প্রয়াত লেখিকা সেরিনা জাহানের স্মৃতির প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা জানাই।

* আলোচকের ফেসবুক ঠিকানা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ