একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনালেখ্য এহ্‌সান মাহ্‌মুদের উপন্যাস "একাত্তরের লাল মিয়া" | নুসরাত জাহান

এহসান মাহমুদের উপন্যাস "একাত্তরের লাল মিয়া"

পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামক যে স্বাধীন, সার্বভৌম ছোট্ট একটি রাষ্ট্র স্থান দখল করে আছে -এর পেছনের ইতিহাস খুব একটা সুখকর নয়। একদিনে এই রাষ্ট্রের জন্ম হয়নি। একটা সুদীর্ঘ সময় পরাধীন থাকার পর, অনেক শোষণ এবং বঞ্চনার ইতিহাস পেরিয়ে, দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করে। স্থান করে নেয় বিশ্ব মানচিত্রে। আর এই স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া এক বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনালেখ্য নিয়ে তরুণ লেখক, সাংবাদিক এহ্‌সান মাহ্‌মুদের প্রথম উপন্যাস 'একাত্তরের লাল মিয়া'। উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র মাদারীপুরের দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা মো. লাল মিয়া। মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়ার যুদ্ধকালীন সাহস, শঙ্কা ও যুদ্ধপরবর্তী হতাশাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে উপন্যাসের কাহিনী। একজন লাল মিয়ার মধ্য দিয়ে বর্ণিত হয়েছে দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকদের নানা বঞ্চনা ও হতাশার গল্প।

আমি কি এই বাংলাদ্যাশ পাওনের জন্যি যুদ্ধ করেছি?
দ্বিতীয় সংস্করণের বইটি হাতে নিলেই রাইফেল উচিয়ে মাথায় লাল গামছা বাধা আধো-স্পষ্ট একজন মুক্তিযোদ্ধা! যার চোখে অনেকটা অসহায়ত্বের ছাপ পরিলক্ষিত হলেও মুখ একেবারে অস্পষ্ট। যার উপরে মোটাদাগে লাল হরফে বইটির এবং কালো অক্ষরে লেখকের নাম উল্লেখিত। প্রচ্ছদ শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী যে উপন্যাসটির বার্তা এই এক দৃশ্যেই উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন সে কথা আর বলতে! উপন্যাসের শুরুতেই রয়েছে একটি সন, একটি মাস এবং একজন মুক্তিযোদ্ধার কথা। মুক্তিযুদ্ধের অনেক বছর পেরিয়ে এসেও মাইকের ঘোষণা যাকে অস্থির করে তোলে। 'মুক্তিযুদ্ধ' শব্দটি শোনামাত্রই যার রক্তের ভেতর দিয়ে কিসের যেন একটা স্রোত বইয়ে যায়। হাত-পা শক্ত হয়ে ওঠে, স্থির হয় চোখের মণি। ঝাপসা চোখে ভেসে ওঠে পুরো একাত্তর। আর এই স্মৃতিতেই লেখক ঘটনাপরম্পরায় তুলে আনেন মুক্তিযুদ্ধ কালীন ঘটনাপ্রবাহ।

বাংলার বসন্ত বরাবরই অন্য দেশের থেকে ভিন্ন। তবে ১৯৭১-এর মার্চে যে বসন্ত এসেছিলো সেই বসন্তের কৃষ্ণচূড়া ছিলো রক্তের চেয়েও লাল। গাছে গাছে শিমুল ফুটেছিল যেন টুকরো টুকরো আগুনের মত।



-এমন এক বাসন্তী সকালে বাংলার তৃণমূল অঞ্চলের খুব সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের বিচি কলা দিয়ে পান্তাভাত খাওয়া সকালের বর্ণনা দিয়ে খুলে যায় স্মৃতির দুয়ার। তারপর একে একে উঠে আসে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যনীতি, শোষণ-শাষন আর পাকিস্তান আর্মির লাগামহীন অত্যাচার-নিপীড়ন কিভাবে খুব সাধারণ মানুষকেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে তাড়না যুগিয়েছিলো। নিশ্চিত মৃত্যুর সম্ভাবনা জেনেও ঠিক কিভাবে একজন বৃদ্ধ পিতা তার একাধিক সন্তানকে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।  জানা যায় স্থানীয় রাজাকাররা কিভাবে পাক আর্মিদের প্রত্যন্ত অঞ্চল চিনিয়ে নিয়ে এসেছেন, তাদের সহযোগিতা করেছেন। পাকিস্তানি শাষক গোষ্ঠী কিভাবে হিন্দু-মুসলিম জাতিগত বৈষম্য আরো দৃঢ় করে তুলেছেন। উঠে আসে যুদ্ধকালীন সময়ে অভিভাবকের অনুপস্থিতিতে পরিবারগুলো ঠিক কতটা অসহায় জীবন যাপন করেছেন।

বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের যে যুবকরা জীবনে রামদা বা বর্শার মত সামান্য অস্ত্র হাতে নেয়নি মুহূর্তেই তাঁরা যেন হয়ে ওঠে একেকজন সাহসী বীর যোদ্ধা। তাঁরা বুঝে যায় -

 

যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্রই আপনজন ও পরম বন্ধু।

 

যা মুক্তিযোদ্ধাদের বরাত দিয়েই একান্ত আলাপনে ব্যক্ত করেন লেখক। যেমন,

আচ্ছা শরিফ, বলতে পারো, সবাই যুদ্ধের জন্য এমন উতলা হয়ে আছে কেন?


কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দুই আঙুলের ফাঁকে রাখা সিগারেট শেষ বারের মত টান দেন শরিফ।

সিরাজ, মানুষের মনের দীর্ঘ দিনের ক্ষোভ ও কষ্ট এখন শক্তিতে পরিণত হয়ছে। তাই এখন সবাই চায়, পাকিস্তানিদের শোষণ থেকে নিজেদের মুক্ত করতে। (পৃ. ৫৯)


হ্যান্ড গ্রেনেডকে তারা আনারস বলে অবহিত করে। কাদামাখা গ্রামের খাল-পানি অর্থাৎ বাংলার প্রকৃতি এবং আবহাওয়া ও জলবায়ু যে সবসময় সহয়তা করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের সে বিষয়ও বার বার উঠে এসেছে উপন্যাসটিতে৷ পাকিস্তান আর্মিতে কর্মরত থাকলেও বর্তমানে একুশ সদস্য বিশিষ্ট দলের মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জমির শেখ মনে করেন, 

 

যুদ্ধ মানেই শত্রু শত্রু খেলা। যেখানে প্রতিপক্ষের লাশ নিয়ে আনন্দ মিছিল পর্যন্ত বের করা হয়। হাসিমুখে জীবন বিলিয়ে দেওয়াটাই যেখানে বীরত্ব।

 

আবার যোদ্ধাদের সদা উজ্জীবিত রাখবার অসম্ভব দক্ষতা সম্পন্ন খালেদ মোশাররফের প্রায়শই উক্ত বাক্য হলো, 

কোন স্বাধীন দেশ জীবন্ত গেরিলাদেরকে চায় না। চায় মৃত গেরিলা।


উপন্যাসটিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বীরযোদ্ধাদের বীরত্বগাথার পাশাপাশি নারীদের ভূমিকাও খুব গুরুত্ব সহকারে উপস্থাপিত হয়েছে। শুধু প্রেরণাময়ী হিসেবে নয়, ডালিয়ার মত তরুণীর অপারেশনে সক্রিয় অংশগ্রহণ যেমন ভিন্ন মাত্রা এনে দিয়েছে। আবার রবীন্দ্রসংগীত শেখার থেকে দেশের সাহায্যে এগিয়ে আসাকে বড় মনে করে শান্তিনিকেতন ছেড়ে আসে মহুয়া। তার সেবাযত্ন দেওয়ার পাশাপাশি দুঃখ-যন্ত্রনা দুর করবার প্রচেষ্টা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক শক্তি যোগানো ও মনোবল দৃঢ় করবার আকাঙ্ক্ষা কম গুরুত্ব পায়নি। এছাড়াও ধর্ষিতা কিংবা স্বামী-সন্তানকে উৎসর্গ করবার ঘটনা তো অতি নৈমিত্তিক। এই একটি ক্ষেত্রেই মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক অন্য রচনাগুলো থেকে এহ্সান মাহমুদের রচনাশৈলী যে ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে, তা অনায়াসে বলা যায়। এছাড়াও পুঁথিপাঠ, গোলেয়া অর্থাৎ বৈশাখী মেলা, কাডাইল নিয়ে গ্রামীণ ছেলে-পুলেদের খেলা করবার বর্ণনার মাধ্যমে বাংলাদেশের গ্রামীণ চিত্র এবং আঞ্চলিকতার যথাযথ উপস্থাপনে লেখক যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

এক বাসন্তী সকালে বাংলার তৃণমূল অঞ্চলের খুব সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের বিচি কলা দিয়ে পান্তাভাত খাওয়া সকালের বর্ণনা দিয়ে খুলে যায় স্মৃতির দুয়ার।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে, অনেক বছর হলো। কিন্তু যে লক্ষ্য, যে তাড়নায় এত মানুষ নিজের সব ধরনের স্বার্থ ত্যাগ করে জনযুদ্ধে ঝাপিয়ে পরেছিলো তা কি আদৌ অর্জিত হয়েছে? স্বাধীনতার আটত্রিশ বছর পরে এসেও মাদারীপুরের খাসেরহাটের সর্বস্ব হারানো দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা লাল মিয়ার দুস্থ জীবনচিত্র ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া যেন চোখে আঙুল দিয়ে বাস্তবতা দেখায়। আতস নামক সামাজিক সংগঠনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রচলিত রীতির বাইরে গিয়ে নিজের অন্তরের কথা গুলো যেন বিক্ষোভে ফেটে পরে। 

 

আমি কি এই বাংলাদ্যাশ পাওনের জন্যি যুদ্ধ করেছি?



-এই একটি আপ্ত বাক্যের সাথে তার ব্যক্তিগত গন্ডি থেকে ওঠানো প্রতিটি প্রশ্ন যেন স্বাধীন দেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়েই আঘাত করে। একজন লাল মিয়ার মাধ্যমে উচ্চারিত হয় অসংখ্য বীরের না বলা মনের কথা। বইটির শেষে "লেখকের নেওয়া সাক্ষাৎকার" এবং "সহায়ক গ্রন্থ ও তথ্যসূত্র" -এর সংযুক্তি বলে দেয় এটি শুধু একটি নিছক উপন্যাস নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনালেখ্য। একইসাথে  মুক্তিযুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধপরবর্তী সাধারণ মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও প্রাপ্তির বাস্তব চিত্রায়ন।

পেশাগত জীবনে এহ্সান মাহামুদ একজন সাংবাদিক। এজন্যই হয়ত তার তথ্য সংগ্রহ, যথাযথ তথ্য উপস্থাপনের প্রচেষ্টা এবং সজ্জা শৈলী উপন্যাসটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন নাজমুন নাহার কচিকে। বইটির ভূমিকা লিখেছেন ভাষাসংগ্রামী, কবি, প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্রগবেষক আহমদ রফিক।


**********

একাত্তরের লাল মিয়া (উপন্যাস)
এহ্‌সান মাহ্‌মুদ

প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী

প্রকাশক: মোহাম্মদ মাকসুদ (হাওলাদার প্রকাশনী)
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি, ২০১৫

পৃষ্ঠা: ১২৮
মূল্য: ২৫০.০০৳ মাত্র
ISBN: 978-984-8967-13-3

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ