প্রশান্ত মৃধার "স্তব্ধ পাখসাট" উপন্যাস নিয়ে মোস্তফা অভির আলোচনা

প্রশান্ত মৃধার "স্তব্ধ পাখসাট" উপন্যাস নিয়ে মোস্তফা অভির আলোচনা


প্রশান্ত মৃধার "স্তব্ধ পাখসাট" উপন্যাসটি বাংলা কথাসাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন, যা একদিকে সম্পর্কের গভীর স্তর উন্মোচন করে অপরদিকে রাষ্ট্র-সমাজের নিঃশব্দ অথচ প্রবল অনুপ্রবেশকে প্রতিফলিত করে। উপন্যাসটির পটভূমিতে রয়েছে একটি গবেষণা-ভিত্তিক ভ্রমণ, দীর্ঘদিনের বান্ধবীর আকস্মিক ডাক, অতীতের জটিলতা এবং ডিজিটাল নজরদারির অভিঘাতে উদ্ভূত এক অন্তঃসারশূন্যতা। এটি নিছক একটি কাহিনিনির্ভর রচনা নয় বরং পাঠককে তলিয়ে যেতে বাধ্য করে ব্যক্তিজীবনের জটিলতা, সম্পর্কের সংজ্ঞাভাঙা অভিজ্ঞতা এবং রাষ্ট্রের অতিসক্রিয় তবে নীরব নিপীড়নের রাজনৈতিক বাস্তবতায়।

একজন গবেষক বন্ধুর অনুরোধে কথক যান গোলাপগঞ্জের ঢাকাদক্ষিণে, শ্রীচৈতন্যের পৈতৃক ভিটায় একটি দুর্লভ পদ্মাপুরাণ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। সেখানে থেকে আকস্মিকভাবে দীর্ঘদিনের বান্ধবী দরিয়ার আমন্ত্রণে শ্রীমঙ্গলের এক রিসোর্টে পৌঁছান। কথকের সঙ্গে দরিয়ার সম্পর্ক প্রেমের চেয়ে গভীর, তবে সামাজিক সংজ্ঞার বাইরে। রিসোর্টে বসেই উন্মোচিত হয় দরিয়ার অন্য এক বন্ধুর সম্পর্কঘটিত টানাপোড়েন এবং একটি বিপজ্জনক ফেসবুক পোস্ট। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে শুরু হয় নজরদারি, হুমকি ও নিরাপত্তা হেফাজতের মতো পরিণতি। এদিকে কথক ও দরিয়া বুঝতে পারে, তাদের চারপাশে সব স্তব্ধ—যেন কারও কোনো ডানা আর ঝাপটায় না। সেই উপলব্ধিতে তারা আবিষ্কার করে তারা জীবন্মৃত।

দরিয়া ও কথকের সম্পর্ক একেবারেই প্রচলিত ছাঁচে বাঁধা নয়। এখানে প্রেম আছে কিন্তু তা দেহজ নয়; হৃদয় আছে কিন্তু তা আকাঙ্ক্ষাময় নয়। এটি একধরনের আত্মিক সহাবস্থান যা প্রেম বা বন্ধুত্বের সীমা অতিক্রম করে। এই সম্পর্কের মধ্য দিয়ে লেখক এমন এক জগতের ইশারা দেন, যেখানে সম্পর্কের সংজ্ঞা পুনর্নির্মিত হয়।

শ্রীমঙ্গলের রিসোর্টে যে শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ বর্ণিত হয়েছে, তা দ্রুতই রূপ নেয় উত্তেজনার এক পর্দায়। একটি ফেসবুক পোস্ট—যা প্রথমে তুচ্ছ ঠেকে, ক্রমশ তা একটি রাষ্ট্রীয় বিপদের আভাস হয়ে ওঠে। লেখক দেখান, কীভাবে ব্যক্তিগত জীবনের গহনে রাষ্ট্রীয় নজর অনুপ্রবেশ করে। এই জায়গাটি আমাদের চিনিয়ে দেয় আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ছায়াসঙ্গী ভূমিকা, যা নাগরিকের নিঃশ্বাস পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে। দরিয়ার চরিত্রে লেখক নারীসত্তার অভিজ্ঞতা, আত্মগ্লানি এবং প্রতিরোধের ভিন্নস্বাদ দিয়েছেন। তার অতীত, যা উপন্যাসে সরাসরি উচ্চারিত হয় না, তবুও পাঠকের মনে রয়ে যায় একপ্রকার দীর্ঘশ্বাস হয়ে। এটি একধরনের নির্যাতনের স্মৃতি, যা নারীকে নীরব করে অথচ ক্রমাগত তাড়া করে বেড়ায়। এই অনুচ্চারিত স্মৃতি নারীবাদী পাঠের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক প্রেক্ষাপট তৈরি করে।

উপন্যাসের শিরোনাম স্তব্ধ পাখসাট-এ নিহিত রয়েছে গভীর রূপক। পাখসাট, অর্থাৎ এমন একটি অবস্থা—যেখানে কোনো ওড়াউড়ি নেই, ডানার ঝাপট নেই। এটি শুধু প্রকৃতির নয়, মানুষের, রাষ্ট্রের, এবং সমষ্টিগত সময়চেতনারও প্রতীক।

লেখক এই স্তব্ধতার ভেতর দিয়ে দেখান, ব্যক্তি যেমন নিঃস্পন্দ হয়ে পড়ে, তেমনি রাষ্ট্রও হয়ে ওঠে নির্বাক—কিন্তু ভীতিকর।

স্তব্ধ পাখসাট আমাদের এমনই একটা উপন্যাস, যা উচ্চকণ্ঠে নয় বরং নিঃশব্দে প্রশ্ন তোলে। এটি এমন এক পাঠ, যেখানে প্রেম, রাজনীতি, নিপীড়ন এবং অস্তিত্বজিজ্ঞাসা all merge into one। এই উপন্যাসে আমরা কেবল একটি গল্প পড়ি না, আমরা দেখি আমাদের সময়ের প্রতিচ্ছবি। একটি সমাজ, যেখানে ব্যক্তির ভাষা কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্র তাকে নিঃশব্দে বসিয়ে রাখে আর মানুষ বোঝে, সে বেঁচে আছে কিন্তু বেঁচে নেই।

প্রশান্ত মৃধার ভাষা একাধারে সংযত ও সংবেদনশীল। তিনি মিতভাষায় গভীর অর্থ তুলে ধরতে পারেন। উপন্যাসজুড়ে যে ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, তা আবেগের চেয়ে অন্তর্জগতে বেশি ডুবে থাকে। বাক্যগুলো দীর্ঘ নয় কিন্তু প্রতিটি বাক্যে থাকে পরিপক্বতা, একধরনের কাব্যিক নৈঃশব্দ্য। যেমন: 

 

চারপাশে সমস্ত ওড়াউড়ি বন্ধ। এমনকি পাখা ঝাপটানোও না।


এই এক লাইনে তিনি মানবমন ও সামাজিক স্তব্ধতা উভয়কেই ধারণ করেন, যা কাব্য ও দর্শনের মিলনে তৈরি। গল্পের গঠন সরল হলেও উপন্যাসটি বয়নরীতিতে বহুস্তরীয়। কথক যখন গোলাপগঞ্জে যান, তখন পাঠক একধরনের রূঢ় বাস্তবতার মধ্যে প্রবেশ করে। তারপর রিসোর্টের পরিসরে উপন্যাসটি এক মনস্তাত্ত্বিক অঞ্চলে প্রবেশ করে। এই স্থানান্তর একটি প্রাচীন পাণ্ডুলিপি অনুসন্ধান থেকে আধুনিক ডিজিটাল আতঙ্কের মধ্যে যাত্রা, যা লেখকের গদ্যদক্ষতার প্রমাণ। এখানে স্থান বদলের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনোভাব বদল, যা লেখক নিখুঁতভাবে পরিচালনা করেন।

দরিয়া ও কথক—এই দুই চরিত্রই যেন পরিপূর্ণ না হয়ে উঠেই পূর্ণতা পায়। লেখক তাদের আবেগ, দ্বন্দ্ব, অতীত ও বর্তমানকে পুরোপুরি উদ্ঘাটন করেন না বরং পাঠকের কল্পনার জন্য ফাঁক রাখেন। এই অস্পষ্টতা চরিত্রগুলোর মানবিকতা বাড়ায়। দরিয়া বিশেষভাবে জটিল এক চরিত্র। তার অতীত, তার বর্তমানের নির্ভরশীলতা এবং একইসঙ্গে একধরনের প্রত্যয়—এই দ্বৈততা চরিত্রটিকে গভীর করে তোলে।

স্তব্ধ পাখসাট নামটিই একটি রূপক—ডানাবিহীন, শব্দহীন, দিকহীনতার প্রতীক। গোটা উপন্যাসে এই প্রতীকটি প্রসারিত হয়ে যায়:

  • ব্যক্তির স্তব্ধতা
  • সম্পর্কের স্তব্ধতা
  • রাষ্ট্রীয় স্তব্ধতা

একটি ফেসবুক পোস্টের মতো আপাত তুচ্ছ ঘটনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের ছায়া এসে পড়ে ব্যক্তিজীবনে। লেখক এখানেই রূপকের মধ্য দিয়ে বাস্তবতার বয়ান তৈরি করেন। যা কেবল ঘটনা নয় বরং ভাবের স্তরে কাজ করে। লেখক এখানে যে সময়কে তুলে ধরেছেন, তা কেবল দৃশ্যমান নয়, অনুভবযোগ্যও। ফেসবুক পোস্ট, নিরাপত্তা হেফাজত, নজরদারি—এই উপাদানগুলো আমাদের সময়ের অদৃশ্য বাস্তবতা। লেখক এগুলোকে সরাসরি না বলে উপন্যাসে ইঙ্গিতের ভাষায় বলেছেন। ফলে, উপন্যাসটি হয়ে ওঠে সময়ের নান্দনিক প্রতিবেদন। এই উপন্যাসে যে সংলাপগুলো আছে তা লেখকের চাতুর্যচায় হয়ে গেছে গদ্য। ফলে একটানা গদ্যভাষ্যে গল্প এগিয়ে যায়। উপন্যাসের শেষদিকে “জীবন্মৃত” হবার যে উপলব্ধি—তা সাধারণ উপসংহার নয় বরং এটি একটি দার্শনিক-মেটাফোরিক ক্লাইম্যাক্স। এখানে লেখক শিল্পের ভাষায় সমাজ ও ব্যক্তি উভয়ের ভাঙনের ক্যানভাস আঁকেন। এটি নিছক একটি শেষ বাক্য নয়—এটি একটি চিন্তার চিহ্ন।

প্রশান্ত মৃধার স্তব্ধ পাখসাট একটি আধুনিক সাহিত্যকর্ম, যার শিল্পগুণ তার ভাষা, বয়নরীতি, রূপক, প্রতীক, সময়জ্ঞান এবং চরিত্র নির্মাণের দিক থেকে বিশেষভাবে উজ্জ্বল। উপন্যাসটি কোনো সস্তা আবেগ বা রোমান্সে ভর করে না বরং নান্দনিক স্তব্ধতায় পাঠককে টেনে নেয় আত্মবিশ্লেষণ ও সময়সচেতনতার গভীরে।

আর তাই এই উপন্যাসকে বলা যেতে পারে—স্তব্ধতার ভাষায় লেখা এক দ্রোহের কাব্য।


**********

স্তব্ধ পাখসাট
প্রশান্ত মৃধা


প্রকাশকাল: ২০২৫
প্রকাশক: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ঢাকা, বাংলাদেশ
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১৭৪
মূল্য: ৫৬০/-
ISBN: 9789845065832

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ