পত্রচালিত কবিতা ❑ তানজিন তামান্নার 'কুরিয়ার সিরিজের কবিতা' প্রসঙ্গে সাম্য রাইয়ানের মূল্যায়ন

তানজিন তামান্নার 'কুরিয়ার সিরিজের কবিতা' বইয়ের প্রচ্ছদ



তানজিন তামান্না কবিতায় নির্মাণ করেছেন নিজস্ব বার্তাবাহী ভূগোল, যার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে থাকে সম্পর্ক, প্রত্যাশা, অপেক্ষা আর বিচ্ছেদের অপার বার্তাবলয়। তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘কুরিয়ার সিরিজের কবিতা’ এই সময়ের বাঙলা কবিতায় এক ব্যতিক্রমী সংযোজন; যেখানে প্রতিটি কবিতা একেকটি চিঠি, আর প্রতিটি চিঠিই যেন একেকটি দৃশ্যান্তরের নকশা। কোথাও শালিক হয়ে কুরিয়ার আসে, কোথাও আসে পদ্মফুল, কোথাও আবার ঘুম অথবা জানলার কাঁচ। উত্তর-আধুনিক এই কবির কবিতায় বারবার ফিরে আসে প্রেরক, প্রাপক, খাম, ফুটফুটে হাঁসের বাচ্চার মতো নরম শব্দের অবতারণা, আবার কখনো শালিক বা ঘুমের মত বিমূর্ত অভ্যন্তরীন অবস্থাও হয়ে ওঠে কাব্যিক চরিত্র। এখানে কবিতা হয়ে উঠেছে কুরিয়ার—প্রেরক, প্রাপক আর মাঝে দূরত্বে ভরসা রেখে যাওয়া অদৃশ্য এক বার্তাবাহক। মলাটবদ্ধ গ্রন্থখামে শুয়ে আছে দূরবর্তী সম্পর্ক, নিরব প্রতীক্ষা, স্মৃতি ও আবেগের ভাঁজ খোলা সুর।



বইটি প্রথমেই পাঠককে এক ঘুমভাঙা অবচেতনতার দিকে ডেকে নিয়ে যায় এভাবে—



তোমার ঘুমের পাশে বসে থাকতে থাকতে— কিছুট‍া ঘুম নিয়ে ঘুমিয়ে পড়বো আমিও
    …
   আমাদের ঘুমের ভেতর এসে দাঁড়াবে— দীর্ঘকায় বেনাপোল এক্সপ্রেস




এই ‘ঘুম’ কেবল নিদ্রা নয়, বরং এক জীবনঘুম—যার মধ্য দিয়ে যাতায়াত করে ট্রেনের মতো দীর্ঘ শ্বাস। ঘুমিয়ে থাকাই এখানে এক ধরনের প্রতীক্ষা, যেখানে স্মৃতির ট্রেন এসে থামে না—সে চলে যায়, রেখে যায় শব্দহীনতা। কবি প্রতীক হিসেবে বেছে নিয়েছেন ‘বেনাপোল এক্সপ্রেস’—যা সীমান্তের ট্রেন, এক রাষ্ট্র থেকে অন্য রাষ্ট্রে যায়, অথচ ভেতরে এক অনন্ত অদৃশ্য যাত্রার আভাস।



তাঁর কবিতায় চিঠির ধারণাটি হয়ে ওঠে সময়ের মধ্যকার এক নৈর্ব্যক্তিক কথোপকথন। ঘুম, ট্রেন, প্ল্যাটফর্ম—সবই এখানে জীবিত প্রতীক। পাঠকের হৃদয়ে তারা এসে দাঁড়ায় নম্র-নৈঃশব্দ্যে, কুরিয়ারের মতো। এক ধরনের বিমূর্ত অথচ স্পষ্ট কল্পজগত নির্মাণ করে। ‘কলতলা’ কবিতায় শালিকের স্নান এবং পিপাসার সম্ভাবনা দিয়ে যে সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়, তা নিছক পাখি ও মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক নয়, বরং একাকিত্ব ও স্নেহের মিশেলে শূন্যতার প্রতীকায়ন:


তবু পিপাসা মেটাতাম তোর পালকের জলে
    স্নান দেখতে দেখতে বয়ে যায় আমার একমাত্র দুপুর




‘একমাত্র দুপুর’—হয়তো একটি জীবনের অতিক্রান্ত সময়, যেখানে শুধু পালকের জলই হয়ে উঠতে পারে অন্তর্গত শান্তির সম্ভাবনা। তানজিন তামান্নার কবিতায় সময় কখনোই নিরপেক্ষ থাকে না; বরং তা স্মৃতি, শরীর, ঘুম ও ঘরের মধ্যে বিচরণশীল।



‘ঘুমের ফাঁদ’ কবিতায় আমরা দেখতে পাই জানলার কাঁচ ঠোকরানো বোকা শালিককে, যার ডানায় ভেসে বেড়ায় ঘুমচুরির কৌশল। কবি লিখছেন—



জানলার কাঁচে ঠোক মেরে ঘুম ভাঙিয়ে দিলো বোকা শালিক!
    …
    আমার ঘুম নিয়ে উড়ে যায় বোকা শালিকের দল




শালিক এখানে নিছক পাখি নয়; সে ঘুমের দূত, স্মৃতিচিহ্ন বহনকারী পাখি, যে ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে ভেঙে ঢুকে পড়ে ঘরের মধ্যে—তবু কোনো অভিযোগ থাকে না, কেবল “চেয়ারের হাতলে ভেজা গামছাটা পড়ে থাকে অভিযোগহীন।”

 

এই রকম দৃশ্যচিত্র তানজিন তামান্নার কবিতার স্বাক্ষর, যেখানে অবজেক্টগুলো নিছক বস্তু নয়, বরং চরিত্র হয়ে ওঠে, এবং নিঃশব্দ-ভাষায় বলতে থাকে অনুচারিত কথাগুলো।



‘বৃষ্টির রাতে’ কবিতায় পদ্মফুল ও ডিঙার সংলাপে রচিত হয় এক নারীর নীরব প্রত্যাবর্তনের কাহিনি—



ডিঙা বাইতে বাইতে বউটির দু’হাত পদ্মফুল হয়ে যায়
    …
    খাতায় আঁকা ছিলো ডিঙা ও একটি পদ্মফুল




শালিকের মতো এখানেও পদ্মফুল কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্য হয়ে থাকে না; সে নারী শ্রম ও স্মৃতির প্রতীক হয়ে ওঠে, যা খাতায় আঁকা থাকলেও বাস্তবের জলে ভিজে গিয়ে মুছে যায়। এ কবিতাগুলোর বিশেষত্ব এই—এরা অপ্রত্যক্ষ কথা বলে, বিমূর্ত বর্ণনায় বাস্তবচিত্র আঁকে।



‘মানিপ্ল্যান্ট’ কবিতায় কবি স্পর্শের স্মৃতি ও অনুপস্থিতির অভ্যন্তরে ভাঙনের এক অনবদ্য ভাষ্য রচনা করেছেন—



আপনার হাত নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে
    ভিজে গেছে সকল শুকনা কাপড়, সকল ঘরবাড়ি




মানিপ্ল্যান্ট যেমন গ্রীলের সান্নিধ্যে বাড়ে, তেমনি স্মৃতিও বাড়ে অনুপস্থিত মানুষের কাপড়ের গন্ধে। বারান্দায় ফেলে রাখা কাগজ আর বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া কাপড়—এ যেন আমাদের হারানো স্পর্শের প্রতিমা।



‘লুকানো কোলাহল’ কবিতায় কবি যেভাবে ‘কোলাহল’কে আড়াল করেন, আবার বসন্তের উদ্দামতাকে ঢেকে তুলে ধরেন বিষণ্ণতায়, তা দেখবার মতো:



বসন্ত তারপরও ডেকে তোলে তুমুল হাওয়ায়
    কোকিলের ঠোঁটে ঠোঁট রেখে তুলে আনে প্রচণ্ড বিষণ্ণতা!




এই কাব্যিক দ্বৈততা—উল্লাস ও বিষণ্ণতা একসাথে নিয়ে আসা—তানজিন তামান্নার কবিতার গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। তিনি বাতাশ, পাতা, কোকিল—সবকিছুর ভেতর অনুপস্থিত মানুষের সংলাপ ফোটান।



কবিতায় সাম্প্রতিকতম প্রকৃতি-সংলগ্ন রাজনীতি ফুটে ওঠে ‘অনাহারী মাছ’ কবিতায়। সেখানে কবি বলেন—



ক্ষুধার্ত হলে পুড়তে পারে বাঁশি
    …
    ধানক্ষেতের জলে ঘুরে বেড়াচ্ছে অনাহারী মাছ




ফলে ক্ষুধা কেবল মৎস্যজগতে আবদ্ধ না থেকে হয়ে উঠছে সামাজিক বাস্তবতার প্রতীক। বৃষ্টির জলে ভেজা ধানক্ষেত—সেই জলেও শান্তি নেই, মাছের তৃপ্তি নেই—শুধুই অনাহার। এবং সেই অনাহারকে বাঁশির দূরত্ব দিয়ে মেপে কবি নিজেই প্রশ্ন রাখেন:



তুমি কি যাবে পোড়া বাঁশির টানে?




এই কবিতাগুলোর বিশেষ সুর হলো—সবচেয়ে গোপন শব্দটিকেই সামনে আনা, যেন ফিসফিস করে বলা কথাটি প্রতিধ্বনি তোলে এক গভীর নির্জনতায়।



‘শালিকের সঙ্কেত’ কবিতায় ফিরে আসে বার্তার গোপন ভঙ্গি। জোনাকীর আলো, মশারির ফাঁক, শালিকের ডানার সংকেত—সবই হয়ে ওঠে অর্ধস্পষ্ট বার্তা। কবি লিখছেন—



মশারীর ফাঁকে আটকে পড়া জোনাকীকে বাঁচানো গেলোনা!
    …
    গর্তধরা যে বৃষ্টিতে আটকে গেছে শালিকের ফাঁকে—
    ওরা পৌঁছে দিতে চায় ভুবুক জোনাকির আভাস




এইখানে শালিক, জোনাকি, মশারী—সবকিছু যেন বার্তার বাহক। মেঘের ফাঁকে যেমন হঠাৎ আলোর রেখা দেখা যায়, ঠিক তেমনই এই কবিতার প্রতিটি পংক্তি একেকটি সংকেত, যা জীবন ও মৃত্যু, উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির মাঝখানে বাঁধা পড়ে আছে।



তানজিন তামান্না বুঝিয়ে দেন—প্রেমের ভাষা আর কেবল মানবীয় নয়, বরং এক জীব-প্রকৃতি-স্মৃতি সংলগ্ন অনুরণন। ‘শালিকের সংকেত’ নামটি শুনেই বোঝা যায়—এখানে প্রকৃতি নিজেই বার্তাবাহক। কবি যেন বলছেন, প্রকৃতির প্রতিটি দৃশ্য একেকটি লুকোনো চিঠি—যা পাঠককে নিজে পড়ে নিতে হবে।



‘ঘরভর্তি সমুদ্র’ কবিতায় চিত্ররূপ পায় ঘরের ভিতরের বাহ্যিকতা, যেখানে ঘরও সমুদ্র হয়ে যায়, দুপুরও ভেসে যায়:



ঘরে রাখা ঝিনুকই সমুদ্দুরের গান!
    ঘরভর্তি সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছে শীতের দুপুর




এই কবিতাগুলো যেন জীবনভর্তি খামের মতো—বাহকের গন্তব্য অনিশ্চিত, বার্তার ভাষা নীরব, প্রেরক-প্রাপক শুধু সময়ের অলিতে গলিতে দেখা দেন।



‘কুরিয়ার সিরিজের কবিতা’ এক অনন্য কাব্যিক গ্রন্থনা; পত্রচালিত জীবনব্যাখ্যার রূপরেখা, দীর্ঘ আদানপ্রদানের আর্কাইভ।


 

তানজিন তামান্না এখানে কেবল কবি নন, এক অনন্ত প্রেরক। তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে আমরা আরেকবার অপেক্ষা করতে শিখি, আবিষ্কার করি নৈঃশব্দ্যের সৌন্দর্য।



**********


কুরিয়ার সিরিজের কবিতা
তানজিন তামান্না


প্রকাশকাল: ২০২২
প্রকাশক: উড়কি, ঢাকা।

পৃষ্ঠা: ৪৮
মূল্য: ১২৫
ISBN: 9789849537458



**********


আরও পড়ুন

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ