বহরে শীর্ণ, চিন্তনে আকীর্ণঃ সন্দীপন গুপ্ত’র “পাঁচ সিকে পাঁচ আনা” - রক্তিম ভট্টাচার্য

বহরে শীর্ণ, চিন্তনে আকীর্ণঃ সন্দীপন গুপ্ত’র “পাঁচ সিকে পাঁচ আনা” - রক্তিম ভট্টাচার্য



সন্দীপন গুপ্ত’র “পাঁচ সিকে পাঁচ আনা” নাতিদীর্ঘ, ক্ষীণতনু গল্পগ্রন্থ। পাঁচটি গল্পের সমাহার, যেখানে বর্তমান সময়কে খানিক সরের মতো তুলে ধরার চেষ্টা নজরে পড়ে। গল্পগুলির আকৃতি সুবৃহৎ নয়, বরং, শেষের তিনটি গল্প অণুগল্পের ধারাটিকেও তুলে আনে। তবে, সামগ্রিক বিচারে গল্পগুলি কতখানি সাযুজ্য রাখতে পেরেছে তার প্রকল্পিত সময়ের দাবির তুলনায়, তা প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে উন্মোচিত হবে- আশা করা যায়। আর এই আলোচনার ডিসক্লেমার বলতে নিছক পাঠ-প্রতিক্রিয়ায় এই আলোচনা স্বধর্ম-রক্ষার্থেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। আমরা প্রবেশ করার চেষ্টা করব, গল্প ধরে ধরে তার মনস্তত্ব বিশ্লেষণে, বোঝার চেষ্টা করব চিন্তার ঠিক কোন স্রোতে অবগাহনের পর লেখক তুলে আনতে পেরেছেন এইসব নির্দেশ-বিন্দু।

লেখকের গল্প-ভুবনে প্রবেশ করার আগে প্রথমেই আকর্ষণ করে উৎসর্গপত্র। নিবিষ্ট কাব্যময়তায় বাস্তবের খরতায় আদরের প্রলেপ জড়িয়েছেন গল্পকার। এই বাক্যেই যেন প্রমাণিত হয়ে যায়, লেখকের মধ্যে কবি-মন ও মনন সুস্পষ্টভাবে নিভৃতচারণ করেছে। বইয়ের আকৃতি এবং শিরোনামেও লেগে আছে মৃন্ময়ী রোদ। অপার্থিব সংরাগের ভেতর থেকে রচিত হওয়া আবহাওয়ার খাঁজে কেমনভাবে আত্মগোপন করে আছে নগণ্য জীবনের অস্তিত্ব- তাই সম্ভবত বইটির উপজীব্য।

এবার সরাসরি আসা যাক গল্পগুলির আলোচনায়। যেহেতু, গল্পগুলির প্রত্যেকটির মধ্যে কোনও একমুখী সাদৃশ্য নেই, ফলত আলোচনার দৃষ্টিকোণও পৃথক হবে- বলাই বাহুল্য।


প্রথম গল্প, “আড়াল থেকে”। এই গল্পটি অ্যাপ্রোচের জন্য একটু বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন আছে। ঘটনাপ্রবাহের নিরীখে খানিক উপন্যাসোপম, সন্দেহ নেই। তবে, কবি-মনের অলীক বাস্তবতায় রক্ষিত আখ্যান। এই গল্পে আমাদের হারিয়ে যাওয়া সময় আছে, মফঃস্বলের অতিলৌকিক ঘাম-গন্ধ আছে, মায়ার পরশে সজ্জিত এক আপাত-অবাস্তবিক আদর-সঞ্জাত খতিয়ান আছে। লেখার পরতে পরতে সাসপেন্স আছে, একটা লুকোচুরির আবহ আছে।

প্রসঙ্গত, প্রখ্যাত চিত্রপরিচালকদ্বয় ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো এবং আলফ্রেড হিচককের একটি সাক্ষাৎকার মনে পড়ে, যেখানে সিনেমার জগতে “সাসপেন্স” শব্দটির প্রবাদপ্রতিম জাদুপুরুষ হিচকক ‘সাসপেন্স’ এবং ‘শক’-এর পার্থক্য গড়তে গিয়ে যে উদাহরণটি দেন, তা খানিকটা এইরকম- ধরা যাক, একটি লোকজনপূর্ণ রেস্তরাঁতে একটি আড্ডার দৃশ্য দেখানো হচ্ছে, এবং হঠাৎ একটি টাইম-বোম বিস্ফোরিত হয়। পরে বোঝা যায়, কোনও একটি টেবিলের নীচে বোমাটি রাখা ছিল। এটা হল ‘শক’। ‘সাসপেন্স’-এর ক্ষেত্রে প্রথমের দেখিয়ে দেওয়া হবে, কোথাও একটা টাইম-বোম রাখা আছে, দর্শক জানেন, কিন্তু পর্দায় উপস্থিত চরিত্ররা জানেন না। এইবার আড্ডার দৃশ্য, রেস্তরাঁর আভ্যন্তরীণ দৃশ্য দেখানো হচ্ছে, এবং দর্শক ক্রমশ ঘামে ভিজে উঠছেন, কখন বোমাটি ফেটে পড়বে বীভৎস শব্দে। এই হল ‘সাসপেন্স’। বিশ্বসাহিত্যের থ্রিলার ঘরানার ইতিহাসের ‘হাউডানইট’ জঁরটি অনেকটা এই গোত্রীয়। উপস্থিত সকল চরিত্রকে আমরা সামনে থেকে দেখছি, কিন্তু তারা নিজেদের দেখতে বা বুঝে উঠতে পারছে না।

এই গল্পেও নিয়মটির বাত্যয় ঘটছে না। তফাৎ শুধু ঘরানাটির চারিত্রিক নির্মাণে। একটি রোম্যান্টিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত গল্পের আবহে উপস্থিত চরিত্ররা একে অপরকে দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু আমরা, অর্থাৎ, পাঠকরা পুরো বিষয়টির তাৎপর্য উপভোগ করার চেষ্টা করছি। তবে, ক্লিশে রোম্যান্টিক গল্পের মতো শেষের অংশটি ‘হ্যাপি এন্ডিং’ মেজাজে নির্মাণ করেননি লেখক। সূক্ষ্ম সিনেমাসুলভ মোচড়ে কাহিনিকে দড় করে তুলেছেন সন্দীপন। মনে পড়ে, আমাদের অ্যাডোলেসেন্ট পর্যায়ে প্রায় পাড়া-কাঁপানো সিনেমা “প্রেম আমার”-এর শেষ দৃশ্য, মনে পড়ে, “বোঝে না সে বোঝে না” সিনেমার শেষের শক। গল্পটির ভাষা, বুনন প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে আজকের নিরীখে, তবে কাহিনির বিচারে হয়ত এই আবেগসিক্ত, মেদসম্বলিত ঠাসবুনোটটি না থাকলে শৃঙ্গাররসের বর্তুল ইমারত ভেঙে পড়তে পারত অচিরেই। সে-হিসেবে লেখককে স্মৃতি-জল্পনা এবং নস্ট্যালজিক বাতাবরণের ঝঞ্ঝা উসকে দেওয়ার জন্য সাধুবাদ জানাতেই হয়।

বইটির দ্বিতীয় গল্প, “প্রাঙ্ক-লি-স্পিকিং”। আজকালকার দিনে ক্রমবর্ধমান সামাজিক মাধ্যমের জনপ্রিয়তা এবং বর্তমান প্রজন্মের দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ার দোলাচল বজায় রাখা কাহিনি। তবে, গল্পটির মধ্যে নিগুঢ় বার্তা আছে, একটা সচেতনতার দিক উঠে আসে। যদিও, কাহিনিটি শেষ হয় চমকের মধ্যে দিয়ে, এবং সে চমক হালকা হাস্যরস এবং হ্যাপি এন্ডিং-এর মদতও জোগায়। তা-সত্ত্বেও গল্পটির অন্তঃসলিলে বহমান চোরা দ্বন্দ্ব, এবং ভবিষ্যৎ পৃথিবীর রূপকল্পে ভাবনার চোখরাঙানি, অগোচরে রক্ষিত সুচতুর সতর্কীকরণ সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়াবে না।

তৃতীয় গল্প, “স্বীকৃতিহীন”। সন্দীপন সমাজের চোখে আপাত-নিষিদ্ধ একটা সম্পর্কের মায়াজালের গভীরে তলিয়ে দেখার চেষ্টা করেছেন। ‘অ’সামাজিকভাবে পাতানো সহোদর-সম্পর্কে কীভাবে লেগে থাকে চোখরাঙানি, এবং কেমনভাবে সেই আঙ্গিককে অস্বীকার করে চ্যুত করে তোলে সমাজ- তারই চিত্রায়ন। তবে, গল্পে মেদের পরিসর রয়েছে, এবং বিষয়ের নিরীখে গল্পের বুনন বেশ স্থূল মনে হয়েছে। প্রতিবাদের সুর যদিও এ-গল্পে অগ্রদূত নয়, বরং, বিষাদবিধুর পরিসমাপ্তির অন্তর্ঘাতেই লেখক নির্মাণ করেছেন গল্প-শরীর; তবু যেন, গল্পটি আরও বেশি প্রতীকী হয়ে ওঠার অবকাশ ছিল। শেষ লাইনটি তীব্র অন্তর্ঘাতী হলেও সামগ্রিক গল্পের নিরীখে যেন অযথা ভারী মনে হয়। এখানেই আরেকটু সম্পাদনা প্রয়োজন ছিল বলে ব্যক্তিগত অভিমত।

পরের গল্প, “ধারাভাষ্যকার”। খানিকটা ব্যক্তিগদ গদ্যের আঙ্গিকে লেখা এই আখ্যান। গল্পে বিষাদ যেমন আছে, তেমন আছে মায়াচ্ছন্নতা। ব্যর্থতাকে উচ্চৈঃস্বরে মহিমান্বিত করার চেষ্টা নেই, বরং, দুঃখের অনিঃশেষ জারণে হতাশা এবং গ্লানিবোধকে পরোক্ষভাবে তৃতীয় (বাক্যান্তরে, দ্বিতীয়) পুরুষে ব্যক্ত করা হয়েছে। এই গল্পেও স্থূলতার অংশটি বড্ড বেশি। বাক্য গঠনে, প্রেক্ষিত নির্মাণে অনেকাংশে বর্তমান সময়ের তাগিদের অভাব পরিলক্ষিত হয়। সময়কে অস্বীকার করা হয়নি কাহিনির নিরীখে, কিন্তু লেখার চলনে প্রাচীনপন্থী ছোঁয়া। খাপছাড়া অসঙ্গতি না থাকলে গল্পটি অনন্য উচ্চতায় যেতেই পারত বলে মনে হয়। বিশেষত, কমেন্ট্রিতে ব্যবহৃত বহুশ্রুত বাক্যটির অর্থবহ রবের বিপ্রতীপে শেষাংশের করুণ আর্তনাদ সাংকেতিক বিন্যাসে ইঙ্গিতবাহী হয়ে ওঠার মর্ম খানিক অধরা থেকে গেছে নির্মাণ-কৌশলের অমার্জিত পদক্ষেপে।

বইটির শেষ গল্প, “পরনির্ভরশীল”। গল্পটির অণুত্ব বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, কিন্তু সংযমের অভাবে অভিঘাত স্পষ্ট নয়। অনেকটা যেন বার্তা দিতে চাওয়ার অকারণ প্রচেষ্টা। গূঢ় নিহিতার্থের প্রতি আশ্বাস হারিয়ে উচ্চকিত স্বরে গল্পকে কাহিনির পরত চড়িয়ে পেশ করা হয়েছে। গল্পটির শেষ অনুচ্ছেদ গল্পটির আপাত-গল্পত্বকে প্রবল সন্দেহের চোখে দেখে। গল্পে বার্তার স্থান অনুচ্চ না হওয়াই শ্রেয়। “শেষ হইয়াও হইল না শেষ”-এর যে গভীর অনুভবী রেশ, তা গড়ে ওঠার পর্যাপ্ত সময় পায়নি লেখাটিতে। বিশেষভাবে সক্ষম মানুষের জীবনের গল্প হয়ে উঠতে গিয়েও শুধুমাত্র আক্ষরিক শ্লেষ এবং নেতিবাচক স্পর্শের দাপটে গল্পটি সার্থক হয়ে ওঠার সুযোগ হারিয়েছে বলে মনে হয়েছে।

সামগ্রিকভাবে, “পাঁচ সিকে পাঁচ আনা” পাঁচটি ভিন্নধর্মী গল্পের সমাবেশে একটি শীর্ণকায় গল্পগ্রন্থ, যা জেন ওয়াই প্রজন্মের স্নায়বিক বৃত্তটিকে স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছে স্বঘোষিত মেরুকরণে। পাঁচটি গল্পেই চোখে পড়ে উদ্দিষ্ট সময়ের বিপন্নতা, ক্রমেই এসে পড়ে বিশ্বায়নের প্রভাব এবং সভ্যতার লীনতাপে ক্ষরিত হওয়া লালিত্যের অস্তরাগ। কবিতার ব্যবহার প্রয়োজনমাফিক যথাযথ, শুধু কাব্যময়তায় নয়, পরিস্থিতির সঙ্গে দরকারি ভারসাম্যও বজায় রাখতে অনেকখানি সমর্থ হয়েছেন লেখক। বিষয়-চয়ন ও প্রেক্ষিত-নির্বাচন ভালো, তবে বিন্যাসে ও বুননে আরও যত্নশীল হলে ভবিষ্যতে সময়ের কাঙ্খিত দাবিকে আরও সযত্নে অনুমান করতে পারবেন সন্দীপন- স্থির বিশ্বাস।


**********

পাঁচ সিকে পাঁচ আনা
সন্দীপন গুপ্ত


প্রচ্ছদঃ সুপ্রসন্ন কুণ্ডু

প্রকাশনাঃ এবং অধ্যায়

মূল্যঃ ১২০ টাকা মাত্র (মুদ্রিত)

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ