প্রায় ১৫০ বছর আগের কথা। ঘটনার শুরু ১৮৬৫ সালে, শেষ ১৮৭২-এ। প্রেক্ষাপট, পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েক হাজার বর্গমাইলের গভীর জঙ্গলাবৃত অঞ্চল। সেখানে বাস করে 'তাউংথা' নামে পরিচিত কিছু আদিম জনজাতি। হাজার বছর ধরে সমভূমির মানুষের কাছে ওরা অসভ্য, হিংস্র, বর্বর বলে গণ্য। তার ওপর কারো কারো ধারণা, ওই ভূখণ্ডে সমতলের মানুষের প্রবেশে মানা। ফলে লোকমুখে ছড়ায় নানা উদ্ভট গুজব। ওখানকার অধিবাসীরা নাকি জলের স্পর্শ বাঁচিয়ে চলে, বাকি পৃথিবীর কোনো খবরও ওখানে আসে না!
উনিশ শতকে নিজের প্রাণ বাজি রেখে সেই 'নিষিদ্ধ' দুর্গম এলাকায় প্রবেশ করেছিলেন এক ব্রিটিশ অফিসার, থমাস হারবার্ট লুইন। দুঃসাহসী সেই অভিযানে উন্মোচন হতে থাকে একের পর এক বিস্ময়। গোরা লুইন পাহাড়িদের সঙ্গে আলাপ করেন, ঘনিষ্ঠও হন; সরেজমিনে দেখেন তাদের জীবনযাত্রা। লুসাই জনগোষ্ঠীর লোকেরা ভালোবেসে তাঁর নাম দেয় 'থাংলিয়ানা'। তারপর একটা যুদ্ধের আয়োজন। তথাকথিত 'সভ্যতা' হানা দেয় পাহাড়ের নির্জনে। বাইরের দুনিয়ায় প্রথমবারের মতো পা ফেলে অচিন অঞ্চলের মানুষ।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরল সব রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা নিজের কুশলী কলমে লন্ডন থেকে ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত স্মৃতিকথা আ ফ্লাই অন দ্য হুইল-এ লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন লুইন। সেই বইয়ের পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত অধ্যায়গুলোর বাংলা অনুবাদ নিয়েই থাংলিয়ানা।
পরিচয়পর্ব
"থাংলিয়ানা! থাংলিয়ানা!”
গহিন পার্বত্য এলাকায় লুসাইদের গ্রামে ঢুকতে না ঢুকতে সম্মিলিত কণ্ঠের চিৎকার শোনা গেল। যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই শত্রুপক্ষের কাছ থেকে এমন অভিবাদন মোটেও আশা করিনি। মাত্র দুদিন আগেও এরা আমাদের বিরুদ্ধে প্রাণপণে লড়াই করছিল। নিজেদের গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল। আর এখন ওরা আমার ইংলিশ নামটাকে নিজেদের ভাষায় রূপান্তর করে নিয়ে স্লোগানে পরিণত করেছে অনন্য এক ভালোবাসা আর বিশ্বাসে।
[ক্যাপ্টেন থমাস হারবার্ট লুইন, লুসাই পাহাড় অভিযান শেষে মিজোরামের এক গ্রামে। সময়কাল ফেব্রুয়ারি ১৮৭২]
১.
আরো ৬ বছর আগের কথা। ১৮৬৫ সালে চট্টগ্রাম শহরে পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে এসেছেন থমাস হারবার্ট লুইন নামের এক তরুণ ব্রিটিশ অফিসার। চট্টগ্রাম শহরে কাজ শুরু করলেও কিছুদিন পর শহরের পূর্বদিকে নীলাভ ধূসর দিগন্ত রেখায় ভেসে থাকা পার্বত্য অঞ্চলগুলো তাঁকে হাতছানি দিতে শুরু করেছিল। তিনি বাঙালি সহকর্মীদের কাছ থেকে সে অঞ্চল সম্পর্কে খোঁজ নিতে শুরু করেন। কিন্তু অধিকাংশ তথ্যই নিরুৎসাহিত হওয়ার মতো। বিচিত্র অবিশ্বাস্য অতিলৌকিক গুজবে ভরপুর। ওই পার্বত্যভূমিতে যারা বাস করে তারা হিংস্র, বর্বর, অসভ্য। মনুষ্য জাতির কলঙ্ক। সাপ-ব্যাঙ-কীটপতঙ্গ থেকে শেয়াল-কুকুর-হাতি-অজগর হেন কিছু নাই ওরা খায় না। কোনো কোনো জাতি জ্যান্ত মানুষও কাঁচা খেয়ে ফেলে। মোদ্দা কথা পূর্বদিকের ওই দুর্গম পার্বত্য এলাকা হলো সমতলের মানুষদের জন্য নিষিদ্ধ অঞ্চল। ওই অঞ্চলে প্রবেশ করলে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসা কঠিন কাজ।
তখনো সরকারিভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমানা নির্ধারণ হয়নি। চাকমা, মারমা, মুরং, খুমিসহ আরো বেশকিছু পার্বত্য জাতিগোষ্ঠী ব্রিটিশ অধিকৃত এলাকায় বসবাস করত। এর বাইরে আরো পূর্ব দিকে দুর্গম এলাকায় কিছু জাতি ছিল যারা সম্পূর্ণভাবে ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সেন্দু, সাইলু, হাওলং নামের উদ্ধত এবং স্বাধীনচেতা ওই গোত্রগুলো প্রায়ই হামলা চালাতো ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চলে। বেপরোয়া সেই পার্বত্য জাতিগুলোকে বাঙালিরা সাধারণভাবে কুকি নামে ডাকত। দুর্ধর্ষ কুকিরা সমভূমির বাসিন্দাদের কাছে সাক্ষাৎ যম। তাদের হামলা থেকে পাহাড়ি বাঙালি শ্বেতাঙ্গ কেউ বাদ যায় না। ব্রিটিশ শাসনাধীন এলাকায় বসবাসকারী পার্বত্য জাতিগোষ্ঠীগুলোও তাদের হাত থেকে রেহাই পায় না।
হারবার্ট লুইন ১৮ বছর বয়সে জীবিকার তাগিদে ভারতবর্ষে এসেছিলেন ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময়। সামরিক বাহিনীর একজন শিক্ষানবিশ কর্মকর্তা হিসেবে উত্তর ভারতের কর্মস্থলে কাজ শুরু করেন। তারপর নানান ঘাটে বদলি হতে হতে ১৮৬৫ সালে নোঙর করেছিলেন চট্টগ্রাম শহরে। চট্টগ্রামে এসেই তিনি এখানকার সবুজ সজীব অরণ্য আর পাহাড়ের প্রেমে পড়ে যান।
অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় লুইন পার্বত্য অঞ্চলের বৈরী পরিস্থিতির কথা শুনে আরো বেশি আগ্রহী হয়ে পড়লেন। চট্টগ্রাম শহরের কেন্দ্রে সুদৃশ্য টিলার ওপর তৈরি বাড়ির জানালা দিয়ে তাঁর দৃষ্টি প্রায়ই চলে যেত পূর্ব দিগন্তে ভেসে থাকা অজানা-অচেনা রহস্যময় পাহাড়ের নীলাভ রেখার দিকে। তাঁর বুকে নতুন একটা অঞ্চল আবিষ্কারের নেশা জাগতে শুরু করে।
২.
১৭৬১ সাল থেকে চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসন জারির পর সরকারিভাবে যে অঞ্চলটা শাসনযোগ্য ছিল, তার বাইরে বিরাট একটা এলাকা ছিল ব্রিটিশদের আওতার বাইরে। চট্টগ্রামের পূর্বদিকের পার্বত্য অঞ্চলে বিভিন্ন পার্বত্য জাতির স্বাধীন বসবাস ছিল। মোগল আমলে সীমিত নিয়ন্ত্রণ ছিল ওদিকের কিছু এলাকায়। কিন্তু অধিকাংশ এলাকা ছিল নিজস্ব গোত্রশাসিত। পার্বত্য এলাকায় চাষাবাদের জমি ছিল খুব কম। আবাদি জমির পরিমাণ কম থাকায় খাজনার অংকটা তেমন লোভনীয় ছিল না। তাছাড়া দুর্গম অঞ্চল বিবেচনায় ওই অঞ্চল নিয়ে শাসকপক্ষের আগ্রহ ছিল কম।
ফ্রান্সিস বুখাননের কথা বাদ দিলে চট্টগ্রামে শাসন শুরু হওয়ার প্রথম একশ বছর ওই অঞ্চলে তেমন কোনো ইউরোপিয়ানের পা পড়েনি। ফ্রান্সিস বুখানন ১৭৯৮ সালে চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলে টেকনাফ পর্যন্ত ভ্রমণ করেছিলেন। তারপর কর্ণফুলী নদী ধরে পূর্বদিকে বরকল পর্যন্ত গিয়েছিলেন। বুখানন ইস্ট ইন্ডিয়া পার্বত্য অঞ্চল ভ্রমণ করেছিলেন কোম্পানির নির্দেশে কফি কিংবা মশলা চাষের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক।
কিন্তু ক্যাপ্টেন লুইনের পার্বত্য অভিযান ছিল স্বতঃপ্রণোদিত। তিনি দুরন্ত ছেলেদের মতো ঘর ছেড়ে পালানোর মতলব করেছিলেন। যে পথে আগে কোনো ইউরোপিয়ানের পা পড়েনি, সেই পথ আবিষ্কারের এক অদম্য নেশায় তিনি চট্টগ্রামের তাঁর নিজের শাসনাধীন সীমানা ছাড়িয়ে অজানা পথে চলতে শুরু করেন। মাত্র দুজন দেশি কর্মচারী সাথে নিয়ে প্রায় নিঃসঙ্গ সেই অভিযাত্রার প্রাথমিক ফলাফল ছিল তাঁর জন্য প্রাণঘাতী। যদিও চূড়ান্ত ফলাফলে ব্রিটিশ শাসনের সীমানা সম্প্রসারণ হয়েছিল বিস্তীর্ণ পার্বত্য অঞ্চলজুড়ে।
তিনি দক্ষিণে বান্দরবানের পাহাড় জঙ্গলাকীর্ণ পথ কেটে, পায়ে হেঁটে, নৌকায় চড়ে কালাদান নদীর তীরে এক নিষিদ্ধ অঞ্চলে গিয়ে পৌঁছে যান। সেখানে বাস করত দুর্ধর্ষ সেন্দু জাতি। যাদের ভয়ে চট্টগ্রামের অন্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠীগুলো তটস্থ থাকে। সেন্দু এলাকায় প্রবেশ করতে গিয়ে তিনি নিজের প্রাণ বিপন্ন করে বসেছিলেন। বিচিত্র ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে বহুকষ্টে তিনি প্রাণ নিয়ে ফিরে এসেছিলেন চট্টগ্রামে।
চট্টগ্রামে ফিরে সুস্থ হওয়ার পর তিনি আবারো পাহাড়ের ডাক শুনতে পেলেন। এবার তাঁকে সরকারিভাবে পার্বত্য অঞ্চলের সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে নিয়োগ করা হয় ১৮৬৬ সালে। তিনি চন্দ্রঘোনায় নিজের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন। কিন্তু শাসন করতে গিয়ে তিনি টের পেলেন, কাজটা যতটা আনন্দের ভেবেছিলেন মোটেও সেরকম নয়। ওখানে লুকিয়ে আছে নানান ভয়ানক বিপদ। লুসাই পাহাড়ের হিংস্র পার্বত্য উপজাতিদের আক্রমণ থেকে চট্টগ্রামের সাধারণ পার্বত্য জাতিগোষ্ঠীগুলোর নিরাপত্তা বিধান করা ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। লুসাইদের ঝটিকা আক্রমণ ঠেকানোর শক্তি ছিল না কারো। দুর্গম বনাঞ্চলে বিক্ষিপ্ত ফাঁড়িতে বসবাস করা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাও ছিল অসহায়। খুন জখম আর অপহরণ ছিল নিত্য ঘটনা। আসামের কাছাড় থেকে দক্ষিণের আরাকান পর্যন্ত কয়েক হাজার বর্গমাইল এলাকা ছিল প্রায় অরক্ষিত।
১৮৭২ সালে তাঁকে যুক্ত হতে হলো দুর্ধর্ষ লুসাইদের বিরুদ্ধে সরকার ঘোষিত একটা যুদ্ধে। যে যুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল, লুসাইদের হাতে অপহৃত মেরি উইনচেস্টার নামক ছয় বছর বয়সি এক ইংরেজ শিশু এবং ব্রিটিশ প্রজাদের উদ্ধার করা। অভিযানে লুইনকে নিযুক্ত করা হয় পলিটিক্যাল অফিসার হিসেবে। জিম্মিদের উদ্ধার এবং যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার পেছনে ক্যাপ্টেন লুইনের কৌশলী অসামরিক কায়দাগুলো ছিল বেশ চমকপ্রদ।
মজার ব্যাপার হলো, ঔপনিবেশিক শাসকচক্রের একজন হিসেবে কাজ করলেও পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন লুইন পার্বত্যবাসীদের কাছে খুব জনপ্রিয় একজন ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। দুর্ধর্ষ লুসাই সর্দার রতন পুইয়াকে তিনি জয় করেছিলেন কূটনৈতিক বুদ্ধি খাটিয়ে। তার সাথে বন্ধুতা তৈরি করে এবং যুদ্ধের সময় তাকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যবহার করে প্রাণক্ষয়ের সংখ্যা কমিয়েছিলেন অনেকাংশে। এসব নানাবিধ কারণে মিজোরামের লুসাইরা তাকে ভালোবেসে থাংলিয়ানা নামে ডাকতে শুরু করে।
তবে থাংলিয়ানা নামের প্রাথমিক উৎসটি বেশ মজাদার। প্রথমবার চট্টগ্রামের পাহাড়ে গেলে বান্দরবান এলাকার মুরং সম্প্রদায়ের এক মোড়লের সাথে পরিচয় হয়। মোড়লের নাম ছিল 'তোয়েকাম তংলুইন'। মোড়লের নাম শুনে তিনি নিজের নামটা বিকৃত করে পাহাড়িদের মতো উচ্চারণ করে বলেছিলেন—
আপনি তো আমার পূর্বপুরুষের দিককার আত্মীয় হন। আমার নামও আরবাট তংলুইন।
এটা ছিল লুইনের কৌশল। তিনি যাত্রাপথে ওই মোড়লের সাহায্য নেওয়ার জন্য তাঁর সাথে বানোয়াট একটা সম্পর্ক তৈরির জন্য তাঁর 'হারবার্ট লুইন' নামটা খানিক বদলে দিয়েছিলেন। অতঃপর তংলুইন নামটা তংলুইন্যা হয়ে থাংলিয়ানায় রূপান্তর হয়েছিল।
লুসাই যুদ্ধের পর থাংলিয়ানার নামে স্থাপন করা প্রস্তর ফলকটি এখনো ভারতের মিজোরাম রাজ্যের সেই গ্রামে দাঁড়িয়ে আছে।
৩.
এই গ্রন্থের সাথে প্রাসঙ্গিক না হলেও পর্বত অভিযানসংক্রান্ত ব্যাপার বলে ক্যাপ্টেন লুইনের পরবর্তী জীবনের একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বদলি হয়ে কয়েক বছর পর তিনি যখন দার্জিলিংয়ের কমিশনার, তখন সেখানে চট্টগ্রামের এক বাঙালির সাথে পরিচয় ঘটে তার। স্থানীয় ভুটিয়া বোর্ডিং স্কুলের হেড মাস্টার তিনি। তাঁর কাছে টম লুইন তিব্বতি ভাষা শিখতেন।
একদিন কথায় কথায় হেড মাস্টার মশাই জানালেন-তিনি হিমালয় পর্বত অতিক্রম করে তিব্বত অভিযানে যেতে ইচ্ছুক। ঊর্ধ্বতন কর্তা হিসেবে ক্যাপ্টেন লুইনের কাছে অনুমতি চেয়ে একটা আবেদনও করেন।
ক্যাপ্টেন লুইন এমনিতেই বাঙালিদের সুনজরে দেখতেন না। তাছাড়া অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জেনেছেন বাঙালিরা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ে চড়ার ব্যাপারেও অযোগ্য। তাদের সঙ্গী করে তিনি বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন বান্দরবানে। সেরকম এক বাঙালির কাছ থেকে অতি দুর্গম হিমালয় পর্বত পেরিয়ে তিব্বতে যাওয়ার খায়েশ হয়েছে দেখে তিনি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। তুচ্ছতার সাথে ছুড়ে ফেলেছিলেন তাঁর আবেদনপত্র।
তিনি ওখানে একটু ভুল করেছিলেন। দার্জিলিংয়ের সেই হেড মাস্টার ছিলেন তাঁর দেখা অন্যসব বাঙালির চেয়ে আলাদা। মাস্টারমশাই সেই উপেক্ষা আর পরিহাসের ধার না ধেরে প্রবল জেদে আরো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি সংগ্রহ করে তিব্বত অভিযানে গিয়েছিলেন এবং সবাইকে তাক লাগিয়ে ফিরে এসেছিলেন এক বিরল সফলতার জয়মাল্য গলায় পরে। সেই হেডমাস্টারের নাম শরৎচন্দ্র দাশ। যিনি পরবর্তীকালে তিব্বত বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিশ্বখ্যাত হয়ে ওঠেন। ততদিনে অবশ্য ক্যাপ্টেন লুইন চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে নিজের দেশে ফিরে গিয়েছিলেন।
8.
থমাস হারবার্ট লুইন পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগোষ্ঠীসমূহের ইতিহাস রচনায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। চাকমা রানি কালিন্দীর সাথে তাঁর বৈরী সম্পর্ক থাকলেও চাকমা জাতির ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তিনি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছিলেন। পরবর্তীকালে চাকমাদের ইতিহাস রচনার কাজে সেই গ্রন্থের অনেক তথ্য কাজে লাগিয়েছিলেন ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন লেখক-গবেষক।
বলে রাখা ভালো, ১৯৯২ সালে প্রকাশিত জন হোয়াইটহুডের লেখা থমাস লুইনের একটি জীবনীগ্রন্থ আছে Thangliena : A Life of T.H. Lewin নামে। সেই গ্রন্থের সাথে এই 'থাংলিয়ানা'র অনুবাদঘটিত কোনো সম্পর্ক নেই।
এই গ্রন্থটি রচিত হয়েছে স্বয়ং লুইনের লেখা এবং ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত A Fly on the Wheel; Or, How I Helped to Govern India গ্রন্থ অবলম্বনে। এখানে সেই গ্রন্থের চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক নির্বাচিত অংশগুলো বাংলাভাষী পাঠকের জন্য অনূদিত এবং সম্পাদিত হয়েছে।
এই গ্রন্থকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করে তাতে কিছু উপ-শিরোনাম যোগ করা হয়েছে। মূল গ্রন্থে এগুলো না থাকলেও পাঠকের সুবিধার্থে সম্পাদনাপর্বে যোগ করা হয়েছে। সেই সাথে অপ্রয়োজনীয় কিংবা বাহুল্য বিবেচিত হওয়ায় কিছু বিবরণ কাটছাঁটও করা হয়েছে।
এই গ্রন্থে সংযোজিত ছবিগুলোর মধ্যে কয়েকটি নেওয়া হয়েছে ক্যাপ্টেন লুইনের 'অ্যা ফ্লাই অন দ্য হুইল' থেকে। কিছু ছবি সংগ্রহ করা হয়েছে লুসাই যুদ্ধসংক্রান্ত আর্কাইভ, gettyimages, shutterstock ইত্যাদি সাইটের ফ্রি রিসোর্স থেকে। মেরি উইনচেস্টারের ছবি দুটি নেওয়া হয়েছে The Illustrated London News পত্রিকার ১৮৭২ সালের ২৫ মে সংখ্যা থেকে।
যে যুগে চট্টগ্রামের স্থানীয় লোকেরাই পূর্বদিকের ওই পার্বত্য অঞ্চলে যাওয়ার সাহস পেত না, সে যুগে একজন ভিনদেশি প্রায় একাকী ভ্রমণ করে এমন কিছু দুর্লভ ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন যা এই যুগেও সমান আকর্ষণীয়। উনিশ শতকে ওই অঞ্চলে দাপটের সঙ্গে ব্রিটিশদের মোকাবেলা করা কুকি বা লুসাই বলে কথিত সেন্দু, সাইলু, হাওলং জাতিগোষ্ঠীর পরবর্তী পরিণতি কী হয়েছিল সেসব নিয়ে তেমন কাজ হয়নি এদেশে। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত বলা যায় উনিশ শতকেই তাদের সকল দাপটের অবসান ঘটেছিল। ক্যাপ্টেন লুইন যেসব অঞ্চলে বিচরণ করেছিলেন সেই এলাকা বর্তমান মানচিত্রে ভারত, বাংলাদেশ ও বার্মা তিন দেশের মধ্যে বিভক্ত। ত্রিদেশীয় সেই সীমান্ত অঞ্চল এখনো দুর্গম বিবেচিত। সমগ্র উপমহাদেশের অন্যতম অস্থিতিশীল এবং রহস্যময় অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হয়।
সেই দুর্গম রহস্যময় অঞ্চল নিয়ে আধুনিক পাঠকের চোখে বিস্ময় জাগানোর মতো অনেক বিচিত্র ঘটনাসম্ভার নিয়ে রচিত পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রাচীনতম এবং রোমাঞ্চকর ভ্রমণ বিবরণী 'থাংলিয়ানা'।
সূচি
- পরিচয়পর্ব
- প্রথম নোঙর (১৮৬৫)
- ১. কর্ণফুলীর শহর চট্টগ্রাম
- ২. নতুন কর্মক্ষেত্রের শুরুতে
- ৩. সীতাকুণ্ড পাহাড়ের আগ্নেয় জ্বালামুখ
- ৪. কাঙ্ক্ষিত পদোন্নতি
- ৫. দূর মফস্বল পরিদর্শনে
- ৬. বন্যহাতির মুখোমুখি
- ৭. কক্সবাজারে হাওয়া বদল
- ৮. নতুন অভিযানের স্বপ্ন
- নীল পাহাড়ের অভিযান
- ৯. দক্ষিণ চট্টগ্রামের পার্বত্য পথে
- ১০. মুরংদের গ্রামে
- ১১. গভীর পার্বত্য জঙ্গল পেরিয়ে সাঙ্গু নদীর তীরে
- ১২. সীমান্তের খরস্রোতা নদীতে
- ১৩. সাঙ্গু থেকে কালাদান নদীর পথে
- ১৪. সেন্দু জাতির খোঁজে
- ১৫. কিয়োদের গ্রামে
- ১৬. অতর্কিত আক্রমণের মুখে
- পথভ্রষ্ট স্বপ্ন
- ১৭. আকিয়াব থেকে দ্বিতীয় সেন্দু অভিযান
- ১৮. অপ্রত্যাশিত আক্রমণে বিপন্ন প্রাণ
- ১৯. দুর্গম অজানা পর্বতে পথ হারানো
- পাহাড়ে বদলি (১৮৬৬)
- ২০. ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ফিরে আসা
- ২১. চন্দ্রঘোনায় নতুন দায়িত্ব
- ২২. লুসাই গ্রামে অনিশ্চিত যাত্রা
- ২৩. লুসাই সর্দার রতন পুইয়ার মুখোমুখি
- ২৪. আবারো চাটগাঁ শহরে
- পার্বত্য জীবনের মুগ্ধতা বনাম তিক্ততা
- ২৫. প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে ফেলা
- ২৬. সরল পার্বত্যবাসীর মধ্যে গরল
- ২৭. বোমাং রাজার জন্য ফাঁদ
- ২৮. কালিন্দী রানির সাথে দ্বন্দ্ব
- ২৯. মধ্যরাতের আততায়ী
- ৩০. আনন্দ উচ্ছ্বাসের মহামুনি মেলা
- ৩১. বাঙালি মোক্তারের অপকীর্তি
- ৩২. খিয়ং-থা বনাম তাউং-থা
- ৩৩. পাহাড়ের বিয়ে, সম্পর্ক
- ৩৪. জুম চাষের অভিজ্ঞতা
- ৩৫. আরাকানি জাদুকর
- ৩৬. মং রাজার আতিথ্যে
- লুসাই জাতির সন্ধানে
- ৩৭. স্বাধীনচেতা লুসাই জাতি
- ৩৮. রাতের আক্রমণের ফাঁদে
- ৩৯. ইংরেজ লুসাই সর্দার
- ৪০. সাইলু চিফ সাভুঙ্গা
- ৪১. ছুটির ঘণ্টা বাজলো
- লুসাই যুদ্ধ এবং জোলুটি উদ্ধার (১৮৭২)
- ৪২. বিলেতে ছুটি কাটিয়ে বাংলায় ফেরা
- ৪৩. লুসাই অভিযানের প্রস্তুতি
- ৪৪. সাইলু চিফ ভেনলুলার গ্রামে
- ৪৫. তাওরাং ৎলাং পাহাড়ে
- ৪৬. মেরি উইনচেস্টার উদ্ধার এবং সন্ধি চুক্তি
- ৪৭. রতন পুইয়ার সফল দূতিয়ালি
- ৪৮. হাওলং অভিযান
- ৪৯. লুসাই যুদ্ধের বিজয়লগ্নে
- ৫০. লুসাই জাতির অনন্য চরিত্র উন্মোচন
- ৫১. পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে সরকারি পরিকল্পনা
- ৫২. পার্বত্য অঞ্চল জরিপ অভিজ্ঞতা
- ৫৩. আমার ডেমাগিরি জীবন
- ৫৪. পার্বত্য চট্টগ্রামে গুর্খা অভিবাসন
- ৫৫. সারথে লাং পাহাড়ের ওপর আমার নতুন বাড়ি
- ৫৬. লুসাইদের প্রথম কলকাতা দর্শন
- ৫৭. শেষবেলার এক টুকরো দীর্ঘশ্বাস
- সংযোজন :
- মেরি উইনচেস্টার জোলুটি উপাখ্যান
::::::::::
থাংলিয়ানা
থমাস হারবার্ট লুইন
পার্বত্য চট্টগ্রামে এক ব্রিটিশ কর্মকর্তার রোমাঞ্চকর অভিযান
১৮৬৫-১৮৭২
অনুবাদ : হারুন রশীদ
মূল গ্রন্থ : A Fly On the Wheel
প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২৪
প্রকাশক : কথাপ্রকাশ
প্রচ্ছদ : সব্যসাচী হাজরা
মূল্য : ৫০০
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম