চিৎ-তৌৎ-গং : চেনা চট্টগ্রামের অচেনা ইতিহাস- হারুন রশীদ

চিৎ-তৌৎ-গং : চেনা চট্টগ্রামের অচেনা ইতিহাস- হারুন রশীদ

 

অন্তত দুই হাজার বছর ধরে চট্টগ্রাম একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকেন্দ্র। খ্রিস্টপূর্ব যুগে এই অঞ্চলের আর কোনো বন্দর বহির্বিশ্বে এতটা পরিচিত ছিল না। কিন্তু চট্টগ্রামের পরিচিত ইতিহাসের আড়ালে এখনো লুকিয়ে আছে বহু অজানা-অশ্রুতপূর্ব চাঞ্চল্যকর ঘটনা। চারশ বছর আগে চট্টগ্রামের এক নৌবহর সুদূর মালদ্বীপ আক্রমণ করে সেখানকার রাজাকে হত্যা করেছিল, এ তথ্য অনেকেরই জানা নেই। ১৮১১ সালে চট্টগ্রামের সদরঘাট থেকে ১৭টি কামান চুরি হয়ে গেল ব্রিটিশ মালিকানাধীন এক জাহাজ কারখানা থেকে আর সেই ঘটনা বাড়তে বাড়তে পরে রূপ নিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানচিত্র পাল্টে দেওয়া ইঙ্গ-বার্মা যুদ্ধে-এখন যা রীতিমতো বিস্ময়কর মনে হবে। আবার ১৮১৮ সালে চট্টগ্রামে তৈরি একটা জাহাজই ছিল ১৮৪৮ সালে গঠিত জার্মান নৌবহরের প্রথম এবং প্রধান জাহাজ। বাংলাদেশের প্রথম চা ও কফির বাণিজ্যিক বাগানও তৈরি হয়েছিল চট্টগ্রাম শহরে। 

চট্টগ্রামের বিরল প্রজাতির গন্ডার 'মুন্নী বেগম' ১৮৭২ সালে পাড়ি দিয়েছিল লন্ডন চিড়িয়াখানায়। চেনা চট্টগ্রামের এমনই সব চমকে দেওয়া অচেনা ইতিহাস নিয়ে এই বই।


ভূমিকা : সিলেবাসের বাইরে


ঠিক কত যুগ আগ থেকে চট্টগ্রামে বসতির সূত্রপাত হয়েছিল কিংবা বন্দর হিসেবে কত বছর আগ থেকে যাত্রা শুরু করেছিল, আমাদের কাছে স্থির কোনো প্রমাণ নেই। কিন্তু সেটা যে দুই হাজার বছরের বেশি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্তত দুই হাজার বছর ধরে চট্টগ্রাম একটা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র। খ্রিস্টপূর্ব যুগে এই অঞ্চলের আর কোনো বন্দর বহির্বিশ্বে এতটা পরিচিত ছিল না।

প্রাচীন মিশর, গ্রিক, আরব কিংবা চীনের বাণিজ্য বহর গাঙ্গেয় মোহনার এই বন্দরেই বাণিজ্য করতে আসত। পণ্যের বিনিময়ে পণ্য কিনে নিয়ে যেত। ভিনদেশি সওদাগরেরা এই বন্দর দিয়ে চট্টগ্রামের আশপাশের সবগুলো রাজ্যের সাথে বাণিজ্য করত।

বিদেশি জাহাজ যখন এই বন্দরে নোঙর করত তখন তাদের সাথে কিছু অজানা গল্প, কিছু অদেখা ঘটনাও উড়ে আসত। সেই সব গল্পের অধিকাংশই হারিয়ে গেছে। এই পথে যারা এসেছেন সবাই বইপত্র লেখেননি। অল্প যে কয়েকজন লিখেছেন, তার অধিকাংশই আমাদের নাগালের বাইরে। ইতিহাসের কাজ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে দুয়েকটি ঘটনা হাতে এসে পড়ে-সেগুলো জড়ো করেই এই সংকলন প্রচেষ্টা।

দুই হাজার বছর আগে যে গ্রিক নাবিক এই অঞ্চলে এসেছিলেন তিনি দেশে ফিরে গিয়ে 'পেরিপ্লাস অব ইরিথ্রিয়ান সি' না লিখলে আমাদের জানা হতো না গাঙ্গেয় নামের প্রাচীন এক বন্দর ছিল মেঘনা মোহনার কাছে। কিংবা ১৬০৭ সালে যে ফরাসি নাবিক চট্টগ্রাম এসেছিলেন তিনি দেশে ফিরে গ্রন্থ প্রকাশ না করলে আমাদের কখনো জানা হতো না একদা এক বাঙালি নারী মালদ্বীপের রানি হয়েছিলেন। জানা হতো না চট্টগ্রাম থেকে একদল সৈন্য গিয়ে মালদ্বীপের রাজাকে হত্যা করেছিল।

১৮১১ সালে চট্টগ্রামের সদরঘাট থেকে ১৭টি কামান চুরি হয়ে গেল ব্রিটিশ মালিকানাধীন এক জাহাজ কারখানা থেকে। সেই ঘটনা বাড়তে বাড়তে পরবর্তীকালে রূপ নিয়েছিল ইঙ্গ-বার্মা যুদ্ধে এবং সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানচিত্রই বদলে গিয়েছিল। দেশে ফিরে অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ অফিসারেরা স্মৃতিকথা না লিখলে সেই সব ঘটনাও হয়তো জানা হতো না।

কয়েক বছর আগে 'ফ্রিগেট ডয়েচল্যান্ড' নামের ১৮১৮ সালে চট্টগ্রামে তৈরি একটা জাহাজের বিষয়ে লিখেছিলাম। কিন্তু তখনো জানা ছিল না সেই জাহাজটি ছিল ১৮৪৮ সালে গঠিত হওয়া জার্মান নৌবহরের প্রথম এবং প্রধান জাহাজ। মূলত সেই জাহাজটি দিয়েই জার্মান নৌবাহিনীর আদি যাত্রা শুরু হয়েছিল। আবার লন্ডনে গ্রিন উইচ মেরিটাইম জাদুঘরে খোঁজ করতে গিয়ে পাওয়া গেল ১৭৯২ সালে চট্টগ্রামে তৈরি 'শার্লট অব চিটাগং' নামের চমৎকার একটা জাহাজের তথ্য ও ছবি।

আমাদের জানা আছে বাংলাদেশের প্রথম চা বাগানটি যাত্রা শুরু করেছিল চট্টগ্রাম শহরে। কিন্তু জানা ছিল না তার আগেই চট্টগ্রাম শহরে কফি চাষ শুরু হয়েছিল। চট্টগ্রাম শহরের মাঝখানে বিশাল এক কফি বাগান ছিল। চট্টগ্রামের বন্যপ্রাণীদের নিয়ে খোঁজ করতে গিয়ে 'মুন্নী বেগম' নামের এক বিখ্যাত গন্ডারের খোঁজ পাওয়া গেল ১৮৭২ সালের লন্ডন চিড়িয়াখানায়। বিরল প্রজাতির সেই গন্ডার রামুর জঙ্গল থেকে লন্ডনে গিয়েছিল।

১৮৩৭ সালে চট্টগ্রামে একটা ঐতিহাসিক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল ভূমির খাজনা আদায় নিয়ে। চট্টগ্রামের ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট বেধড়ক পিটুনি খেয়েছিলেন গ্রামের লোকদের হাতে। ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় সেই ঘটনা নিয়ে একটা ডকু ফিকশনও এই সংকলনে থাকছে।

এই অঞ্চলের কত উপাখ্যান হারিয়ে গেছে কেউ লেখেনি বলে। এ রকম গল্পগুলো প্রচলিত ইতিহাসে থাকে না, কিন্তু এদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কিংবা আকর্ষণ কোনো অংশে কম নয়। চেনা চট্টগ্রামের অচেনা ইতিহাস আবিষ্কার করার এই প্রচেষ্টার মধ্যে পাঠক যদি কিছু আনন্দের খোঁজ পান, আমাদের পরিশ্রম পনেরো আনা সফল।

পরিশিষ্ট অংশে ব্রিটিশ কর্মকর্তা হিরাম কক্সের ডায়েরির একটা অংশ যুক্ত করা হয়েছে। আমরা জানি হিরাম কক্সের নামে কক্সবাজার শহর গড়ে উঠেছিল। তিনি দক্ষিণ চট্টগ্রাম সীমান্তে আশ্রয় নেওয়া আরাকানি শরণার্থীদের দেখভাল করার দায়িত্বে ছিলেন। চট্টগ্রামে আসার দুই বছর আগে তিনি বার্মায় ব্রিটিশ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার সময় কিছু বিচিত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। পাঠকের কাছে কৌতূহলোদ্দীপক হতে পারে ভেবে সেই অভিজ্ঞতার কিছু অংশ রাখা হয়েছে।

সবশেষে নামকরণ। 'চিৎ-তৌৎ-গং' প্রাচীন আরাকানি শব্দ। চট্টগ্রাম নামের উৎস হিসেবে যে কয়েকটি প্রাচীন সূত্রের কথা অনুমান করা হয় তার মধ্যে এটি অন্যতম। এই শব্দের অর্থ 'আর যুদ্ধ নয়'। প্রায় হাজার বছর আগে আরাকানিরা চট্টগ্রামে একটা যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পর বিজয় স্মারক হিসেবে কর্ণফুলী নদীর তীরে এই শব্দটা পাথরে উৎকীর্ণ করেছিল। পাথরটা হারিয়ে গেলেও কিংবদন্তিটা রয়ে গেছে। এই সংকলন সেই প্রাচীন নামটিকে সংরক্ষণ করছে।
- হারুন রশীদ, চট্টগ্রাম



সূচি


  • মালদ্বীপের বাঙালি রানি এবং চাটগাঁর নৌ-অভিযান
  • ফ্রাঁসোয়া পাইরার্ডের চোখে চট্টগ্রাম
  • আরাকান বিদ্রোহী খিয়েনবিয়েনের পরাজিত স্বপ্ন
  • চাটগাঁর চা বাগানের প্রথম চিঠি
  • জার্মান নৌবহরে চট্টগ্রামের জাহাজ (১৮৪৮)
  • লন্ডনে চট্টগ্রামের গন্ডার 'মুন্নী বেগম'
  • শার্লট অব চিটাগং ১৭৯২
  • আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে-বাঁকবদলের ঐতিহাসিক স্মৃতি
  • চট্টগ্রামের শেষ মোগল ফৌজদার রেজা খান 
  • নেটিভ যেখানে নিষিদ্ধ ছিল: চিটাগং ক্লাবের অতীত
  • পির বদরের চেরাগ এবং ফখরুদ্দিনের চাটগাঁ বিজয়
  • রবীন্দ্রনাথের চাটগাইয়া বন্ধু কেদারনাথ
  • চাকমা রাজবাড়ির রহস্যময় কামান
  • কর্ণফুলী নদীর রহস্যময় পাথর এবং পির বদরের কিংবদন্তি
  • 'ভিলেজ অব চিটাগং ১৮৩৭': পেনসিলে আঁকা শহরের গল্প
  • পরিশিষ্ট
  • হিরাম কক্সের বার্মা ডায়েরি


::::::::::

চিৎ-তৌৎ-গং
চেনা চট্টগ্রামের অচেনা ইতিহাস
হারুন রশীদ


প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২৫
প্রকাশক : কথাপ্রকাশ
প্রচ্ছদ : মোস্তাফিজ কারিগর
মূল্য : ৬০০ টাকা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ