জলধি

জলধি লিটল ম্যাগাজিন এর প্রচ্ছদ

 

যা বলতে চেয়েছি এবং যা বলা হলো না



পুঁজিবাদী সভ্যতার একটা নির্মম আর নিষ্ঠুর চেহারা রয়েছে। তার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে লিটল ম্যাগাজিন বা ছোটকাগজের নিত্যযুদ্ধ। ছোটকাগজ সঙ্কটে ও সম্ভাবনায় কতটা পিঠ সোজা রেখে, নৈতিকতা বিসর্জন না দিয়ে চলতে পারে তা ভাবার সময় পেরিয়ে গেছে। এ কথার মানে এমন নয় যে লিটলম্যাগের সক্ষমতা বা তার অক্ষমতা নিয়ে নতুন কিছু বলবার নেই। তবে তার টিকে থাকার প্রাণান্তকর লড়াই যে সকল যুগেই ছিল, আছে এবং থাকবে এবং তাকে এই অগ্নিপরীক্ষায় সর্বকালেই উত্তীর্ণ হতে হবে তা নিয়ে দ্বিমত করবার অবকাশ নেই বোধকরি। আর এই অগ্নিপরীক্ষা একজন ছোটকাগজ সম্পাদককে কতভাবেই যে দিতে হয়! শুধু কী পরীক্ষা! তাঁকে মোকাবিলা করতে হয় প্রাতিষ্ঠানিক তাঁবেদার, সাহিত্য ইজারাদার ও প্রচার প্রোপাগান্ডার ঝণ্ডাধারিদের। কতটা রক্তাক্ত পথ পাড়ি দিতে হয় একজন সম্পাদকের তা জানে কেবল তার জুতোজোড়া।

সাহিত্যের সৃজনশীলতাকে দ্বিধাহীন চিত্তে গ্রহণ, নব চিন্তা ও চেতনায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গের সঞ্চার, ব্যক্তি ও সামগ্রিক মূল্যবোধের মূল্যায়ন, তারুণ্যের চিৎকারকে স্বাগত জানানো, রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধশক্তি হিসেবে নিজের অবস্থানকে পরিষ্কার উপস্থাপনই ছোটকাগজকে আলাদা করে অন্য সব কিছু থেকে। সংঘাতে ও সংগ্রামে লিটলম্যাগকে সাহিত্যের অস্ত্রাগার বলেই ভাবি আমি।

বারুদভরা লিটলম্যাগ মূলত কোন দিকে যাচ্ছে? ইতিহাস ঘাঁটলে লিটলম্যাগ-এর যে লালনভূমি সেখান থেকে কিছুটা নয় আমি বলি বেশ খানিকটাই সরে এসেছে। বাজার ভর্তি বাণিজ্যিক কাগজের ভিড়ে লিটলম্যাগ তার স্বরূপ ও স্বভাব হারাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক তাঁবেদার ও সাহিত্য ইজারাদার এর সংখ্যা বাড়ছে। ফলত তারুণ্যের যে সাহিত্যপ্রবণতা তা রুগ্ন আকার ধারণ করে প্রতিষ্ঠানের তোষামোদি ও প্রচার প্রোপাগান্ডার স্থূলতায় চাপা পড়ে ভগ্ন ও মৃতপ্রায় শাখায় পরিণত হয়েছে। আদর্শিক চেতনা ও মননশীল চর্চার নিশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। আশার কথা এটুকুই যে, এর মধ্যেও ছোটকাগজের চর্চা নিভু নিভু করে হলেও জ্বলছে। আঠারো শতকের মাঝামাঝি প্রকাশিত আমেরিকার বোস্টন থেকে প্রকাশিত, যৌথভাবে রেলফ ওয়ালডো এমারসন ও সারা মার্গারেট সম্পাদিত 'ডায়াল' (১৮৪০-৪৪), বিংশ শতাব্দীতে আমেরিকার শিকাগো থেকে প্রকাশিত ও কবি হেনরিয়েট মনরো এবং কবি এজরা পাউন্ড (বিদেশি সম্পাদক) সম্পাদিত ক্ষুরধার লিটলম্যাগ 'পোয়েট্রিঃ এ ম্যাগাজিন অব ভার্জ' (১৯১২) জাপান থেকে প্রকাশিত 'গারাকুতা বুনকো' (১৮৮৫), ভারত উপমহাদেশে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'বঙ্গদর্শন', অবিভক্ত বাংলায় কলকাতার 'কল্লোল' (১৯২৩), বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত 'কবিতা' (১৯৩০), পঞ্চাশের দশকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ এর 'কৃত্তিবাস', হাংরি জেনারেশন এর 'হাওয়া ৪৯' ঢাকা থেকে প্রকাশিত 'মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা' 'সমকাল' 'স্যাড জেনারেশন' এরকম আরো অনেক নাম বলা যায় যারা লিটলম্যাগ এর আদর্শিক চেতনাকে ধারণ ও লালন করেছেন।

পরিবার, সমাজ বা রাষ্ট্রের গতিপথ পালটে দিতে লিটলম্যাগের জুড়ি মেলা ভার। বাংলাদেশে লিটলম্যাগের যাত্রা শুরু ১৯৪৭ এর দিকে অর্থাৎ দেশ বিভাগের পরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এর সূতিকাগার বলা যায়। এখানকার শিক্ষার্থীরা দেয়ালিকা ও লিটলম্যাগের মাধ্যমে তাদের না বলা কথা, প্রতিবাদ গল্প, কবিতা আর প্রবন্ধের আকারে ছাপতে শুরু করে। ভাষা আন্দোলন শুরু হলে অর্থাৎ ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পরবর্তী সময়ে লিটলম্যাগ ছিল বাংলা ভাষায় প্রতিবাদের অন্যতম অস্ত্র। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ওই সময়ে অনেক বিখ্যাত জাতীয় দৈনিক ভাষা আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করে। লিটল ম্যাগাজিন সেই সব দৈনিক ও তাদের লেখকদের বিরুদ্ধে কলম চালানোর প্রধান ক্ষেত্রে পরিণত হয়। একটা ছোট্ট উদহারণ দিলেই তৎকালীন সময়ে এর ধারত্ব ও ভারত্ব বুঝতে সুবিধে হবে। ১৯৬৭ সাল। বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তাদের নানাবিধ সমস্যা নিয়ে বারংবার কর্তৃপক্ষের কাছে ধন্না দিয়েও কোনো প্রতিকার পায়নি। অবশেষে তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে তাদের সমস্যাগুলো নিয়ে একটা দুই পাতার রম্য লিটলম্যাগ প্রকাশ করবে। যেই ভাবা সেই কাজ। তারা তাদের লিটলম্যাগের নাম দেয় 'বলটু'। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এটা এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে, আন্দোলন করেও যা পাওয়া যায়নি লিটলম্যাগের মাধ্যমে খুব দ্রুতই তারা কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন। কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ড. হাফেজ আহমেদ ছাত্রদের সমস্যা শোনেন এবং তা দ্রুত সমাধানের ব্যবস্থা নেন। তখন হাতে লিখে, সাইক্লোস্টাইল পদ্ধতিতে, আর নানারকম শ্রমসাধ্য মাধ্যমে কাগজ প্রকাশ করেছেন আমাদের সাহিত্যপাগল সম্পাদকগণ। কাজেই নিজেকে নিজে সাহস দেই এই চিন্তা করে যে, আমাদের অগ্রজগণ যদি এত কঠিন সময়েও লিটলম্যাগের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখতে পারেন তবে আমি নই কেন? আশায় বুক বাঁধি...

ইদানীং লিটলম্যাগ নামের কিছু সাহিত্য পত্রিকা দেখে খুব আশাহত হই। আপনি যদি মনে করে থাকেন যে- দশজনের গল্প নিয়ে, পাঁচজনের কবিতা নিয়ে, দুইজনের প্রবন্ধ নিয়ে ছাপিয়ে দিলাম মানেই আমি সম্পাদক বনে গেলাম; তাহলে আপনি বিরাট ভুলের রাজ্যে বসবাস করছেন। ধরুন প্রচারসর্বস্ব কিছু মানুষ নিজেকে একজন সম্পাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে একটা মোটাতাজা সাহিত্য পত্রিকা বের করলেন।

তার গুটিকয়েক সাগরেদ, অনুসারী ও গুণগ্রাহীর লেখা অন্তর্ভুক্ত করে অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন নিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে পত্রিকার প্রচার করলেন। আমি বলছি না তাতে একেবারেই সাহিত্য থাকে না। তবে যেটুকু থাকে তাতে ওরকম পত্রিকা দেখলে আমার সোনার জলে ধোয়া নকল গয়নার কথা মনে পড়ে। এই মনে পড়ায় তাদের, মানে যারা বেশ বুক ফুলিয়ে বলেন, 'প্রতিষ্ঠানের পশম আমি ফালাই না।' আর সেই হুঙ্কারে মিউ মিউ করা কিছু কুসাহিত্যিক (চাইলে কেউ কু বাদ দিয়ে ধামাধরাও পড়তে পারেন) বলে ওঠেন, 'চমৎকার সে চমৎকার/ হুজুরের মতে অমত কার?' তাদের কিছুই যায় আসে না জানি। তবু আপনা মাঝে শক্তি ধরে আমি তো বলবই এরা সবই কালপরম্পরায় প্রতিষ্ঠানের তাঁবেদার নইলে প্রতিষ্ঠান দ্বারা প্রভাবিত সাহিত্য ব্যবসায়ী। তাই চাইলেও গতানুগতিক ধারার বাইরে গিয়ে এদের কিচ্ছুটি করার নেই। থাকবেও না কোনোদিন। আত্মপ্রচারে এরা সাহিত্য পত্রিকার আশ্রয় নেয়। দলবাজি আর গলাবাজি করে সাংগঠনিক ঢোলে পুরো সাহিত্য পাড়া একাকার করে ফেলে। ফলত তারুণ্যের যে মহাশক্তি নিজেদের সৎ ও সাহসী মনোভাব নিয়ে লিখতে বসেন তারা বুঝে উঠতে পারেন না; লিখবেন নাকি দুহাতে কান ঢাকবেন।

লিটলম্যাগ কোন সুরে কথা কইবে। জন্মেই যে সুতীব্র চিৎকারে জানান দেয় আজন্মের ক্রোধ, শিশুকাল অতিক্রম করতে করতেই যে ঘোষণা দেয় নবতর জীবনবোধের, কৈশোরে যে প্রতিবাদী আর দুর্দান্ত আঠারোয় যে বুর্জোয়া মানসিকতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে মোহ আর মাৎসর্যের থোড়াই কেয়ার করে সত্য ও সৃজনের গান গায়। যাকে ক্রফোর 'প্ল্যানড ভায়োলেন্স'-এর সাথে তুলনা করা চলে। চচূষ্যপেয় কর্পোরেট বা ভোগবাদী পত্রিকা যখন তালিয়া বাজানো লেখক তৈরি করে লিটলম্যাগ সেখানে সাহস, সময় ও স্বাতন্ত্র্য তৈরি করে। আবদুল মান্না সৈয়দ এর মতো করেই বলতে হয়, 'লিটল ম্যাগাজিন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে একটি ব্যক্তিগত সুঁড়িপথ'। এই সুঁড়িপথ দিয়েই স্বরচিত সুরের আলো ও স্বরের গাম্ভীর্য চোখে পড়ে। ভুল রীতি আর দায়বদ্ধতায় অবিশ্বাসী পত্রিকা যেখানে প্রতিষ্ঠান বা কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর কাছে মাথা বন্ধক রাখে সেখানে লিটলম্যাগ জীবনের গান গায় প্রতিবাদের তানপুরায়। এই উদ্ধত সাহস, ঋদ্ধ সৃজনশীলতা, প্রথা ভাঙার শক্তি আর নৈতিকতার স্বরলিপি যারা আয়ত্বে আনতে পারেন না তাদের লিটলম্যাগ করার যোগ্যতা ও অধিকার কোনোটাই নেই বলেই মানি।

প্রশ্ন এসে যায় এই চেতনা এখন কেন বিলুপ্তপ্রায়। এটা কী প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখায় লিটলম্যাগকে ঢেলে সাজাবার অপচেষ্টায় নাকি তরুণদের সাহিত্যের প্রতি অনিহা। ভাববার বিষয় বোধকরি। লিটলম্যাগ এ তারুণ্যের ছোঁয়া ও আলো না থাকলে তাকে কী লিটলম্যাগ বলা যায়। তবে হ্যাঁ এই 'ছোঁয়া' আর 'আলো'র ব্যাখ্যাটি জরুরি মনে করছি। জনাকয়েক ছেলেমেয়ের নিজের মতো লিখবে বলে, আত্মদর্শনের ঐশ্বর্য প্রকাশ করার বাসনা নিয়ে যার যার মাটির ব্যাংক ভেঙে যা পেলো এনে জড়ো করে নিজেদের মতো একখানা কাগজ বের করল। সে কাগজের ফর্মা গুনে হতাশ হলেও ফর্ম আর ফিউচার নিয়ে আপনার মনে আলো জাগবেই। এই আলোর নাম আশা। আর সেই আশার হাত ধরে ধরে আপনি তাকে পৌঁছে দিলেন আরো কিছু হতাশ- বিতৃষ্ণ-বিচ্ছিন্ন অন্তরে। এই ভগ্নপ্রায় হৃদয়গুলো আলো পেলো। এই সব উজ্জ্বল তরুণদের জিজ্ঞেস করে দেখুন আমি নিশ্চিত তাদের দশজনে দু'জন অন্তত পাবেন যারা বড় পত্রিকার তাঁবেদারি বা দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের চাহিদা মাফিক লেখা লেখেন না। তারা নিজের স্বস্তিতে লেখেন। কারণ তারা জানেন লেখা নিজ আত্মার প্রশান্তির জন্যে। তারমানে এই দু'জন অন্তত পাওয়া গেল যারা সাহিত্যের মহাকাল ছোঁয়ার জন্যে নিরুত্তাপ ও নিরুদ্বিগ্নভাবে লিখে যান।


এবার আসি সম্পাদকদের কথায়। লিটলম্যাগ এর একজন সম্পাদকের যে তুখোড় প্রজ্ঞা, যে নিবিড় চৈতন্যবাদ, নিজের ক্রিয়েটিভ জোনকে বলা যায় এক প্রকারে ধ্বংসের মুখে দাঁড় করিয়ে দেবার সাহস থাকা প্রয়োজন বলে মনে করি তা এখন বিরল। সুবিধাভোগী, মধ্যস্বত্বভোগী, আর বুর্জোয়া মানসিকতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যে মানুষটা নতুন আলোর যাত্রাপথ তৈরির কারিগর, তিনিই তো হতে পারেন ছোটকাগজের প্রকৃত সম্পাদক। কিন্তু ভাবুন সেই লিটলম্যাগ যখন মেধাহীন, আস্থাহীন, চেতনারহিত, বুলিসর্বস্ব সম্পাদকের হাতে পড়ে তখন সে আর আন্দোলন না হয়ে হয়ে যায় আন্দোলনের ভাষ্কর্য। সমুদ্রের ঢেউ ফ্রেমবন্দী করে এরা যেমন গৃহসজ্জা করেন লিটলম্যাগ নামটিকেও তদ্রুপ ফ্রেমবন্দী করে এরা সাহিত্যের জগৎ সাজাতে চেষ্টা করেন। বিভ্রান্তি আর বিজ্ঞাপনের ধান্দায় দিনাতিপাত করা সম্পাদক আর এদেরই চামচাগিরি করে লেখক হওয়া কিছু গৌণ ও নিম্নরুচির লেখকের হাতে যখন লিটলম্যাগ চালিত হয় তখন যে তার পরিণতি কী হয় ভাবলেই শিউরে উঠি। বাধাহীন, ভয়হীন উচ্ছ্বসিত বুনোফুলে কে যেন ঘাস কাটার মেশিন চালিয়ে নিজেদের আয়তন ও দৈর্ঘ্য মাফিক ছেটে নিলো। মোদ্দাকথা চাইলেই তুমি লকলকিয়ে বেড়ে উঠবে সে সুযোগ ও শক্তি তোমাকে দেয়া হবে না। মোদ্দাকথা কাঁটা, ডালপালা ছেটে এমন করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা যেন চাইলেই হাত বাড়িয়ে ফুলটি তুলে টাই পিনে গুজে নিতে পারো।

অথচ লিটলম্যাগ বলতেই আমরা বুঝি, 

কাটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে দুঃখ বিনা সুখলাভ হয় কী মোহিতে।


প্রভাবিত না হলে একজন নির্মোহ সম্পাদক সাহিত্যের প্রধানতম সূত্রধর হতে পারেন। তাছাড়া সম্পাদকের একটা বিশাল দায়বদ্ধতা থাকে। এই দায়বদ্ধতা থেকেই একজন সম্পাদক সম্পাদনার স্বরুপ খুঁজে পাবেন। প্রশ্ন এটাই যে এই দায়বদ্ধতা কার প্রতি এবং কেন? এই দায়বদ্ধতা সাহিত্যের প্রতি। একটি পত্রিকা সেটা সাহিত্যের ছোটকাগজ হোক কিংবা সাহিত্য পত্রিকা, পাঠকের হাতে তুলে দেবার আগে একটা জিনিস মাথায় রাখতে হয়; লেখক পাঠকের মধ্যবর্তী জায়গায় দাঁড়িয়ে যেন নির্মোহ সম্পাদনার কাজটা করা যায় এবং লেখক ও পাঠকের সেতুবন্ধটা যেন সেই শক্ত থামের উপর দাঁড় করিয়ে রাখা সম্ভব হয়।

অতএব শুরু হলো আমার নিবিড় সাধনা। একটা জুতসই নাম ততদিনে ঠিক করে ফেলেছি। এরপরের সময়গুলো কখন কিভাবে কেটেছে তা আর নাই বা বলি। লেখা সংগ্রহ, বাছাই, সম্পাদনা, কত তিক্ত মধুর স্মৃতি, অস্থিরতা, অপেক্ষা। অবশেষে সব উৎকণ্ঠা উৎসাহ আর আগ্রহের অবশান ঘটিয়ে তার দেখা মিললো। ২০১৭-এর জুলাই মাসে প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর থেকে এ অবধি এগারোটি সংখ্যা আলোর মুখ দেখেছে। আমরা আমাদের মূলনীতি থেকে সরে আসিনি বলেই সংখ্যা নয়, মানের দিকেই যত্নবান ছিলাম বেশি। ভবিষ্যতেও এই ধারা বজায় থাকবে- এমন নিশ্চয়তা এই অনিশ্চিতের বাজারে দিতে না পারলেও আমাদের চেষ্টার খামতি থাকবে না এ নিশ্চয়তা দিতে পারি।


প্রথম সংখ্যা থেকেই নবীন ও প্রবীণ লেখকের নিবিড় সম্পর্কের একটা স্বাচ্ছন্দ্য পথ তৈরির পাশাপাশি নবীন লেখকদের পরিচর্যার বিষয়টিও একজন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব মনে করেছি। এই পরিচর্যা হতে হবে নিবিড়, অনুভূতিপ্রবণ এবং অবশ্যই দক্ষতাভিত্তিক। এই পরিচর্যায় যেমন লেখক বিকশিত হবেন তেমন তৈরিও হবেন। লেখক তৈরিতে একজন সম্পাদকের যে কী অসাধারণ ভূমিকা থাকতে পারে এটা আমরা আমাদের লিটল ম্যাগাজিনের ইতিহাস ঘাঁটলে পেয়ে যাব। একজন বুদ্ধদেব বসু, একজন আহসান হাবীব বা একজন মোহাম্মাদ নাসিরউদ্দিনের হাত ধরে কতশত প্রথিতযশা লেখকেরা উঠে এসেছেন একবার ভাবুন। একটা কথা এক্ষেত্রে না বললেই নয়; সাহিত্য গনিত, রসায়ন বা পদার্থ বিষয় নয় যে শিখে এসে সাহিত্যকর্ম শুরু করে দেবেন। সাহিত্য হচ্ছে ভেতরের স্বতঃস্ফূর্ত সেই অনুভব যা নিজে থেকেই তাগিদ দেবে সৃষ্টিশীলতার ফল্গুধারা প্রবাহে। এই যে প্রবাহমানতা এটাই একজন লেখককে সাহিত্যের পথে সত্তর ভাগ এগিয়ে দেবে। কিন্তু ওই যে বাদবাকি তিরিশ ভাগ। এ গ্যাপটা কিন্তু সবসময় থেকেই যাবে। ওই তিরিশের গ্যাপ পূরণে একজন সম্পাদকের বিশাল ভূমিকা রয়েছে বলে আমি মনে করি। বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে চোখ বোলালেই এ বিষয়টা কিন্তু খুব স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। একজন নবীন লেখকের জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত বিচরণক্ষেত্র হলো ছোটকাগজের উঠোন। নতুন লেখককে উৎসাহ দেওয়া, তার ভুলগুলো ধরিয়ে দেয়া, লেখার তাড়নাকে উসকে দেওয়া- মানে লেখকের ভেতরের আগুনকে পর্যাপ্ত ও পরিণত মাত্রায় প্রয়োগের বিদ্যেটা একজন সম্পাদকই দারুণভাবে বোঝাতে পারেন।

ছোটকাগজের পৃষ্ঠপোষক মেলা আর বাঘের দুধ মেলা একই কথা। খুব সহসা কোন সাহিত্য বান্ধব পাওয়া শুধু অসম্ভবই নয়। রীতিমতো দুঃসাধ্য। এ তো আর বিনোদন বা বাণিজ্যিক পণ্য নয় যে চাইলেন আর কড়কড়ে কিছু নোট আপনার দিকে এগিয়ে দিলো কেউ। পুঁজিবাদ আমাদের এমনই এক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে রেখেছে যেখানে স্বার্থ ছাড়া কেউ পাশ ফিরেও শোয় না। আর এ তো ছোটকাগজ।

'কেন বিজ্ঞাপন দেবো? আমার বেনিফিটটা কি? এইসব সাহিত্য ফাহিত্য দিয়ে কিচ্ছু হবে না ম্যাডাম। আপনি বরং সিনেমা বা অপরাধ জগৎ নিয়ে একটা ম্যাগাজিন করুন না। তাতে আলতা, স্নো, পাউডার, কাজল, শাড়ি, গয়না, এমনকি ন্যাপকিনের বিজ্ঞাপনও পেয়ে যাবেন। তা নয়। এসেছেন ছোটকাগজ নিয়ে। কি হয় এ দিয়ে বলুন তো? কে পড়ে এসব? আর কেনেই বা কে?'- এরকম মহান বাণী আমায় কত যে শুনতে হয়েছে।

সত্যিই তো এসব দিয়ে কী হয়। আমি এদের পালটা জবাব দিতে পারি না। ভোগবাদী যে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়িত সেখানে সাহিত্যের মূল্য ক'ছটাক? আমরা আলতা স্লো পাউডার লাগিয়ে ত্বক ফর্সা করব। হৃদয় ফর্সা করার কী দরকার? কাজল দিয়ে চোখের আকর্ষণ বাড়াব কিন্তু অন্তর্দৃষ্টির প্রখরতা বাড়িয়ে হবেটা কি? শাড়ি গয়নায় দেহ তো ঢাকবে মেধা আর মননের উলঙ্গিনী রূপ কে দেখে? এসব বলেও কোনো লাভ নেই। তাই ঢাল নেই তলোয়ার নেই নিধিরাম সর্দারের মতো শূন্য হাতেই শুরু হলো জলধি যাত্রা।

সেই থেকে পথ চলছি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কখনো হোঁচট খেয়েছি, আশাহত হয়েছি। প্রতিবার সংখ্যা প্রকাশের আগে প্রতিজ্ঞা করেছি এটাই শেষ, আর এ পথে পা বাড়াবো না। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই মাথার পোকা নড়েচড়ে বসেছে। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, 'আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ।'

লন্ডন টাইমস-এ একটি সম্পাদকীয় নিয়ে চার্চিলের মন্তব্য ছিল, 'দ্যা টাইমস ওয়াজ স্পিচলেস ওভার দ্যা আইরিশ হোম রুল এন্ড ইট টুক থ্রি কলামস টু এক্সপ্রেস ইটস স্পীচলেসনেস'। আমি সম্পাদকীয় লিখতে গেলে চার্চিলের এই উক্তিটি সবসময় মাথায় রাখি। একজন যোগ্য সম্পাদকের এমনই তো হওয়া উচিত।

এত কথা নতুন করে কেন বলা? জলধির এই সংখ্যা তাঁদের নিয়ে যারা নিজেদের মেধা, শ্রম ও সময়কে নিরন্তর বিলিয়ে দেন নবীন লেখকের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে। জি, আমাদের আয়োজন- 'সম্পাদকের কথা, সম্পাদকের ব্যথা'। অধিকাংশ ছোটকাগজের সম্পাদকরা লিখেছেন ছোটকাগজ নিয়ে তাঁদের দীর্ঘ কন্টকাশ্রিত পথের গল্প। দু-একটি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের লেখা আমরা গ্রহণ করেছি এ জন্যেই যে আমরা তাঁদের সংকটাপন্ন যাত্রার কথা জানি এবং তাঁদের অভিজ্ঞতার সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিতে চেয়েছি।

জলধির পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল সম্পাদকদের দীর্ঘ যাত্রার গল্প। তাঁদের ভাবনা, বাধা পেরুবার গল্প, উল্লেখযোগ্য সংখ্যা এবং ছোটকাগজ বা সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে তাঁদের দায়বদ্ধতার কথা। সম্পাদকগণ আমাদের আহবানে সাড়া দিয়ে লেখা পাঠিয়েছেন। এতো গাঢ় ও তীব্র লেখা কতদিন পড়িনি! থ্যাঙ্কলেস এই জবও যে কতটা আনন্দ আর ভালোবাসা নিয়ে করা যায় তা লেখাগুলো না পড়লে বোঝা যাবে না।

একেকটি লেখা যেন হীরের দ্যুতি ছড়িয়ে যায় পথে পথে। জলধি সত্যিই অভিভূত এবং কৃতজ্ঞ আপনাদের কাছে। এত অমূল্য সব লেখা ও সাক্ষাৎকারে সমৃদ্ধ হয়ে আসছে আমাদের এবারের সংখ্যা! মোট ৪০ জন সম্পাদক ও ছোটকাগজ ঘনিষ্ট লেখক লিখেছেন ছোটকাগজ ও পত্রিকা নিয়ে তাদের দীর্ঘ যাত্রার গল্প। আপনাদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাসা।

এবার ব্যর্থতার কথা কিছু বলি। কাজটি করতে গিয়ে আমরা সকল ছোটকাগজ সম্পাদকের কাছে পৌঁছুতে পারিনি। যোগাযোগের চেষ্টা যে করিনি তা নয় কিন্তু যে কোনোভাবেই হোক আমরা তাদের অবধি পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছি। এ দায় আমাদের। এ জন্যে ক্ষমাপ্রার্থী। তবে সম্পাদকদের নিয়ে এটাই আমাদের শেষ কাজ নয়। এটা শুরু মাত্র। পরবর্তী সংখ্যায় নিশ্চয়ই আমরা তাদের সাথে পাবো যাদের এ সংখ্যায় পাইনি।

যারা সাথে ছিলেন এই সংখ্যার কার্য সাধনে তাঁদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা। নানাবিধ উপায়ে অসংখ্য মানুষের সহযোগিতা পেয়েছি। তাঁদের প্রতি ভালোবাসা। বিশেষ কৃতজ্ঞতা কথাসাহিত্যিক সেলিম মোরশেদের প্রতি। সংখ্যাটি প্রকাশ করতে গিয়ে অসংখ্যবার আমি তাঁকে বিরক্ত করেছি। তিনি হাসিমুখে আমাকে সহ্য করেছেন সম্ভবত ছোটকাগজ নিয়ে আমার এইসব পাগলামির কারণেই তার সস্নেহ প্রশ্রয় আমি পেয়েছি। অসংকোচ প্রকাশের এই দুরন্ত সাহস আমি এদের মতো মানুষের কাছেই পাই। কৃতজ্ঞতা প্রচ্ছদশিল্পী মোজাই জীবন সফরীর প্রতি। জলধির জন্যে ব্যতিক্রমী একটি প্রচ্ছদ তিনি করেছেন।

ধন্যবাদ ও ভালোবাসা আমার ভাই আশিকুর রহমান প্লাবনকে। জলধির সকল কাজ যার উপর চাপিয়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি। ভালোবাসা লাবণী মণ্ডলকে। জলধির হয়ে একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্যে। ধন্যবাদ প্রুফ রিডার, মেক আপ ম্যান, প্রেসম্যান, বাইন্ডার থেকে শুরু করে সকল বন্ধু স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের।

আপাতত আমার কথা ফুরালো। তবে আমার কী মনে হয় জানেন, লিটলম্যাগ নিয়ে লিখতে গেলে প্রতিবার লেখার শেষে 'চলবে' অথবা 'টু বি কন্টিনিউড' টাইপ কিছু লিখে দেয়া ভালো। কারণ লিটলম্যাগ এমন এক মহাসমুদ্রের নাম যার জলের ফোঁটা একবারে গুনে ফেলবেন তা কী করে হয়, বলুন?
- নাহিদা আশরাফী


  • সূচিপত্র

  • বাংলাদেশের সম্পাদক ও ছোটকাগজ/সাহিত্য পত্রিকাসমূহ.....
  • আমিরুল বাসার - ঈক্ষণ ও সাম্প্রতিক
  • আলমগীর মাসুদ - ভাটিয়াল
  • আহমদ সায়েম - সূনৃত
  • আহমেদ শিপলু - মগ্নপাঠ
  • ইচক দুয়েন্দে - পেঁচা
  • ইলিয়াস বাবর - সুচক্ররেখা
  • এজাজ ইউসুফী - লিরিক 
  • এহসান হায়দার - বঙ্গসভা 
  • কামরুল বাহার আরিফ - মৃদঙ্গ
  • চন্দনকৃষ্ণ পাল - দ্রষ্টব্য
  • পুলিন রায় - ভাস্কর
  • ফজলুর রহমান বাবুল - ঋতি
  • বঙ্গ রাখাল - নিহারণ
  • মনজুর কাদের - কঙ্কাল
  • মনসুর আজিজ - আড্ডাপত্র
  • মনিরুল মনির - খড়িমাটি
  • মাহফুজ রিপন - ব্যাটিংজোন
  • মাহমুদ কামাল - অরণি
  • মাহমুদ নোমান - দেয়াঙ 
  • মোস্তফা হায়দার-সাগরকন্যা
  • শফিক হাসান - প্রকাশ
  • শেলী সেনগুপ্তা - একান্নবর্তী
  • হেনরী স্বপন - জীবনানন্দ
  • পশ্চিমবঙ্গের সম্পাদক ও ছোটকাগজ/ সাহিত্য পত্রিকাসমূহ
  • অমলেন্দু চক্রবর্তী - শৈলী 
  • অলোক মুখোপাধ্যায় - ইসক্রা
  • চন্দন ঘোষ - বহুস্বর 
  • জয়গোপাল মন্ডল- সাহিত্য অঙ্গন 
  • তাপস রায় - সুইনহো স্ট্রিট
  • দেবাশিস সাহা - ছাপাখানার গলি
  • প্রবালকুমার বসু - যাপনচিত্র
  • বিশ্বজিত্ ঘোষাল কোরক 
  • রাজকুমার শেখ - জমিন
  • প্রবন্ধ
  • এইচ এম সিরাজ 
  • জাহেদ সরওয়ার
  • সাক্ষাৎকার- (ছোটকাগজ সম্পাদক)
  • আযাদ নোমান চর্যাপদ
  • আলী আফজাল খান ভিন্নচোখ
  • আহমেদ নকীব শিরদাঁড়া 
  • মারুফুল আলম- প্রতিশিল্প
  • সাক্ষাৎকার- (ছোটকাগজঘনিষ্ঠ লেখক)
  • সেলিম মোরশেদ 
  • সৈয়দ রিয়াজুর রশীদ



::::::::::
জলধি
৯ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০২৫

সম্পাদক : নাহিদা আশরাফী

প্রচ্ছদ : মোজাই জীবন সফরীর চিত্রকর্ম অবলম্বনে
মূল্য : ৪০০ টাকা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ