ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম - আহমদ মমতাজ, রাইহান নাসরিন

প্রচ্ছদ: ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম - আহমদ মমতাজ, রাইহান নাসরিন


ভূমিকা


বাংলাদেশের ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই এ আন্দোলনের সূচনা এবং বাহান্ন'র একুশে ফেব্রুয়ারিতে এসে রক্তাক্ত পরিণতি লাভ করে। সে পথ ধরে বাঙালি জাতি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৬ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার পথে ধাবিত হয় এবং একাত্তরে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে পরাস্ত করে স্বাধীনতা অর্জন করে। বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট তৈরি হয় ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে, যে আন্দোলন বাঙালির আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর।

হাজারো মানুষের রক্ত আর ত্যাগ-তিতিক্ষায় গড়া পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই পূর্ব বাংলার কয়েক কোটি মানুষের আবেগ আর স্বাধীনতার সোনালি স্বপ্নকে ভেঙে খান খান করে দিয়েছিল নবপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা। সাতচল্লিশে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরপরই জাতীয় পর্যায়ে অনেকগুলি ঘটনা সংঘটিত হয়। গণপরিষদের ভাষাতালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেওয়া, পাকিস্তানের মুদ্রা ও ডাকটিকেটে বাংলা ব্যবহার না করা এবং সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ পরীক্ষায় বাংলা বাদ দিয়ে উর্দু ভাষাকে অন্তর্ভুক্তির প্রতিবাদ করা হয়। প্রথমদিকে না হলেও ধীরে ধীরে আশানুরূপ সাড়া পাওয়া যায় এবং 'তমদ্দুন মজলিস' নামক সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ও নানা কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন জোরদার করে। গঠন করা হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবং প্রতিবাদস্বরূপ ৪৮ এর ১১ মার্চ ঢাকা শহরে ধর্মঘট পালন করা হয়। বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক-সাংবাদিক ও ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে সোচ্চার হন এবং সংবাদপত্রে লেখালেখি, সেমিনার- আলোচনায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

ক্রমান্বয়ে অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠন, ছাত্র ও শ্রমিক-কর্মচারীগণ সমর্থন জানিয়ে একাত্মতা প্রকাশ করেন; এগিয়ে আসেন শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সর্বস্তরের মানুষ। প্রকাশিত হয় এ উদ্দেশ্যে তমদ্দুন মজলিসের মুখপত্রস্বরূপ সাপ্তাহিক 'সৈনিক' পত্রিকা। পশ্চিম পাকিস্তানি কায়েমী স্বার্থবাদী সরকার ও তাদের সমর্থনপুষ্ট একটি ক্ষুদ্রগোষ্ঠী নিজেদের হীনস্বার্থে বাঙালির ভাষা-সাহিত্য, সংস্কৃতি-ঐতিহ্য বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ভাষার দাবি অব্যাহত রেখে সাপ্তাহিক 'সৈনিক' পত্রিকার পাতায় নিয়মিতভাবে পাকিস্তান সরকারের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও বাঙালি বিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এবং মুসলিম লীগের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডে পাকিস্তানের সরকারি দল মুসলিম লীগ দ্রুত জনপ্রিয়তা হারায় ও ১৯৫৪ সালে আইন পরিষদের নির্বাচনের মুসলিম লীগ সরকারের ভরাডুবি ঘটে। নির্বাচনে বিপুল বিজয়ের পর পূর্ববাংলার সরকার গঠন করে যুক্তফ্রন্ট। বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে।

১৯৪৭ থেকে ১৯৫২ : ভাষা আন্দোলনের পথ-পরিক্রমায় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলা, মহকুমা শহর ও গ্রামাঞ্চলের বাঙালি শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদসহ ছাত্র-শ্রমিক সর্বস্তরের মানুষ রাজপথের আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন। বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষায় তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষা ও শ্রম- নিষ্ঠা অতুলনীয়। 'ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম' গ্রন্থটিতে চট্টগ্রামে ভাষা আন্দোলনে রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটসহ যাঁরা ভাষা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাঁদের জীবনকথা ও অবদানের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এসকল কৃতি ব্যক্তি তাঁদের জীবনের অমূল্য সময়টুকু ও শ্রম-মেধা নিয়োজিত করেছিলেন দেশ, সমাজ ও জাতিগঠনমূলক কাজে। ভাষাসংগ্রামী ও সংগঠকেরা সারাদেশ জুড়ে আদর্শবাদী এক ঝাঁক মেধাবী ছাত্র-তরুণকে খুঁজে নিয়েছিলেন এবং ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠা ও মুসলিম লীগ সরকারের দুর্নীতি, অব্যবস্থা, বাংলা ও বাঙালি স্বার্থবিরোধী তৎপরতা ও বৈষম্যের দিকটি জাতির নিকট তুলে ধরেন, গোড়াপত্তন করেন ভাষা আন্দোলনের।

এই গ্রন্থ রচনায় সংশ্লিষ্ট ভাষাসংগ্রামীর সাক্ষাৎকারভিত্তিক বর্ণনা ছাড়াও বিভিন্ন লেখকের গ্রন্থ ও পত্র-পত্রিকার সহায়তা নেওয়া হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের তথ্য- উপাত্ত সংগ্রহের বিভিন্ন পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনের আগে ও পরে প্রকাশিত দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকা ও বই-পুস্তকসহ বিভিন্ন দলিল-পত্রাদি দেখতে দিয়েছেন বন্ধুবরেষু মাহমুদ বিন কাসেম (প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম ট্রাস্ট) ও সদ্য প্রয়াত এম আর মাহবুব (ভাষা আন্দোলন গবেষণাকেন্দ্র ও জাদুঘর)। এছাড়া মূল্যবান তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন ভাষা সংগ্রামী ও তাঁদের স্বজন-পরিজনরা। বইটির প্রকাশক স.ম.ইফতেখার মাহমুদকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।

-- আহমদ মমতাজ ॥ রাইহান নাসরিন, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২



সূচিপত্র


বিষয়

জেলা পরিচিতি, নামকরণ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা
বাংলাদেশে ভাষা সমস্যার পটভূমি, ঘটনাপ্রবাহ ও প্রেক্ষিত বিশ্লেষণ
প্রাচীন ও মধ্যযুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা :
প্রেক্ষাপট চট্টগ্রাম-আরাকান
বাংলা প্রীতি-অপ্রীতি
ভাষা বিতর্ক ও শিক্ষার মাধ্যম
ফারসির পরিবর্তে ইংরেজি: মুসলিমদের শিক্ষা সংকট
উর্দু প্রীতি ও বাংলার অবস্থান
রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে
পাকিস্তান সৃষ্টি ও উর্দু ভাষার প্রাধান্য
তমদ্দুন মজলিস : পাকিস্তানোত্তর প্রথম সাংস্কৃতিক সংগঠন
ভাষা আন্দোলনের ঘোষণাপত্র: পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু

অধ্যায় দুই ॥
চট্টগ্রাম : বীর চট্টগ্রাম
ভাষা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট
তমদ্দুন মজলিস ও সাপ্তাহিক সৈনিকের ভূমিকা
প্রগতিশীল ছাত্র-তরুণদের তৎপরতা : মাসিক সীমান্ত প্রকাশ

অধ্যায় তিন ॥
- ঢাকার পরিস্থিতি: চট্টগ্রামে বারুদে আগুন
. চট্টগ্রাম কলেজে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর আগমন ও সংঘটিত ঘটনা
. চট্টগ্রামে বায়ান্ন পূর্ববর্তী অন্যান্য তৎপরতা
. চট্টগ্রামে হরফ প্রবর্তনের চেষ্টা
-. বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি : চট্টগ্রাম ও ঢাকা

অধ্যায় চার ॥
চট্টগ্রামে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ
একুশের প্রথম কবিতা : জন্মকথা
একটি পর্যালোচনা
চট্টগ্রামে শহিদ মিনার
শহরের বাইরে ভাষা আন্দোলন
কক্সবাজারে ভাষা আন্দোলন
চট্টগ্রামে সংঘটিত পরবর্তী ঘটনাবলি
চুয়ান্নর নির্বাচন: মুসলিম লীগের ভরাডুবি
চট্টগ্রামে প্রথম স্থায়ী শহিদ মিনার
শহিদ স্মৃতি পাঠাগার ও দু'পাতা প্রসঙ্গ

ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী অধ্যায়

ঢাকায় বাঙলা কলেজ স্থাপন
চট্টগ্রামে বাঙলা কলেজ প্রতিষ্ঠা

গ্রন্থপঞ্জি ও টিকা
সহায়কগ্রন্থ
পত্র-পত্রিকা
আলোকচিত্র
চট্টগ্রামের ভাষাসংগ্রামী


::::::::::

ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম
আহমদ মমতাজ
রাইহান নাসরিন


প্রকাশকাল : অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২৩
প্রকাশনায় : গৌরব প্রকাশন
প্রচ্ছদ ডিজাইন : চারু পিন্টু
অঙ্গসজ্জা ও রূপায়ণ : আর কে রুবেল
মূল্য: ৫০০ টাকা

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ