আনিসুজ্জামান অনূদিত ‘হুয়ান রুলফো’ রচিত ‘পেদ্রো পারামো’ উপন্যাসের পাঠ প্রতিক্রিয়া- কাজী লাবণ্য

আনিসুজ্জামান অনূদিত ‘হুয়ান রুলফো’ রচিত ‘পেদ্রো পারামো’ উপন্যাসের প্রচ্ছদ


‘পেদ্রো পারামো’ আধুনিক লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের এক অমর সৃষ্টি। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত এই ছোট উপন্যাসটিকে মেক্সিকান সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিপ্লব বলা হয়। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস থেকে মারিও ভার্গাস লোসাসহ অনেক লাতিন আমেরিকান লেখকই বলেছেন, তাঁদের লেখালিখির দিশা খুঁজে পেয়েছিলেন এই বই থেকে। মার্কেসের মতো পৃথিবীখ্যাত লেখক তার লেখালেখির প্রেরণা হিসেবে তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসকে। তিনি বলেন, 

আমি যদি এমন একটি উপন্যাস লিখতে পারতাম তাহলে আর কলম ধরতাম না।


বোর্হেসের মতে, 

পৃথিবীর যে কোনো ভাষায় লিখিত শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলির একটি পেদ্রো পারামো।



এই ছোট উপন্যাসের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য তার ভাঙাচোরা, খণ্ডিত বর্ণনা। প্রচলিত সরলরেখার গল্পকাঠামো এখানে নেই। এখানে দুইয়ে দুইয়ে চার না হয়ে তিন বা পাঁচও হয়। আমাদের আজন্ম পরিচিত ঘটনা পরম্পরা বা ধারাবাহিকতা এখানে অনুপস্থিত। পাঠককে ছুঁড়ে ফেলা হয় জীবিত ও মৃত মানুষের কণ্ঠ, স্মৃতি ও ভ্রমণের ভেতরে। রুলফো এমন এক গদ্য রচনা করেছেন যেখানে বর্তমান, অতীত আর পরলোক সব মিলেমিশে এক হয়ে যায়। এ কারণে উপন্যাসটি একাধারে বাস্তব, অবাস্তব, মিথ ও ইতিহাসের সেতুবন্ধ।

কাহিনি আবর্তিত হয় এক ভূতগ্রাম ‘কোমালা’কে ঘিরে। প্রধান চরিত্র হুয়ান প্রেচিয়া সেখানে আসে তার বাবাকে খুঁজতে, যে হচ্ছে কুখ্যাত জমিদার ‘পেদ্রো পারামো’। কিন্তু সে খুঁজে পায় মৃতদের কণ্ঠে ভরা একটি শহর। সেসব কণ্ঠস্বর নানান কথা বলে।  এখানে ক্ষমতার অপব্যবহার, জমিদারি শোষণ, একনায়কতন্ত্র, গৃহযুদ্ধ পরবর্তী সামাজিক ভাঙন সবকিছু প্রতিফলিত হয়। আবার মৃত্যুর পরও যে কণ্ঠগুলো বেঁচে থাকে, তা মেক্সিকার সংস্কৃতির লোকবিশ্বাস ও ধর্মীয় চেতনার সাথেও মিলে যায়।

রুলফোর গদ্য আশ্চর্যভাবে সংক্ষিপ্ত, অথচ তীব্র। সংলাপ অনেক সময় কেবল শূন্যে ভেসে থাকা কণ্ঠের মতো শোনায়, যেন পাঠকও মৃতদের সঙ্গে কথা বলছে। এখানে প্রকৃতিও এক চরিত্র, শুষ্কতা, ধুলো, নির্জনতা মানুষের ভাগ্যের প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে। এই কাব্যময় ভাষার ভেতরে গভীর রাজনৈতিক ও সামাজিক রূপক লুকিয়ে আছে। 

অনেক পাঠকের কাছে উপন্যাসটি দুর্বোধ্য মনে হতে পারে, আমার কাছেও মনে হয়েছে। তবে অনুভূতির জগতে একটা ভালোলাগা কাজ করেছে কারণ গল্পটি সরাসরি এগোয় না, অনেক চরিত্রই হঠাৎ আসে এবং মিলিয়ে যায়। কিন্তু এই ভাঙনই আসলে মৃত্যুপূর্ব ও পরলোকজ অভিজ্ঞতার জগৎকে সত্যিকারভাবে ফুটিয়ে তোলে।

এটি কেবল একটি উপন্যাস নয়, বরং মৃত্যু ও স্মৃতির মধ্য দিয়ে যাত্রার মতো। এটি দেখায় কিভাবে ইতিহাস ও সমাজ, ব্যক্তি ও শাসক, জীবিত ও মৃত একই টেক্সটের ভেতর সহাবস্থান করে।

লেখক ছিলেন  মেক্সিকান সাহিত্যের এক অনন্য ও প্রভাবশালী সাহিত্যিক। তাঁর রচনার গভীরতা, ভাষার সাবলীলতা ও বিষাদের ছায়ায় মোড়ানো গ্রামীণ বাস্তবতা তাঁকে বিশ্বসাহিত্যে এক আলাদা স্থান দিয়েছে।

তিনি ছিলেন নিঃশব্দ যন্ত্রণার ভাষ্যকার।

ভাষার মধ্যে রয়েছে নীরবতার জোর, সংলাপের মধ্যে কান্না, এবং বর্ণনার মধ্যে প্রেতাত্মার হাহাকার।

আর এটি স্প্যানিস থেকে অনুবাদ করে আমাদের পড়ার সুযোগ দিয়েছেন সাহিত্য সংগঠক, গল্পকার, অনুবাদক, আনিসুজ জামান।

হুয়ান রুলফোর আরেক অনবদ্য সৃষ্টি ‘লেলিহান প্রান্তর’ পড়ার সুযোগ হয়েছিল বিশিষ্ট লেখক শাহাব আহমেদের অনুবাদে। সেটিও অনন্য।

**********

পেদ্রো পারামো
হুয়ান রুলফো

অনুবাদ: আনিসুজ জামান 

প্রকাশক: পাঠক সমাবেশ, ঢাকা

প্রকাশকাল: ২০২৩
পৃষ্ঠা: ১৩২
মূল্য: ৫৯৫

ISBN: 9789849685647

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ