বৃক্ষরোপণ গান- অসীম নন্দন


রাতুল রাহা
বৃক্ষরোপণ গান- অসীম নন্দন
প্রকাশকঃ বাঙ্ময়
প্রকাশকালঃ ২০১৭

একজন কবি প্রতিফলিত হন কিংবা হয়ে যান তার কবিতায়, সেটা সচেতনভাবেই হোক কিংবা অবচেতনভাবে, মানুষের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং চিন্তাসূত্র ধরেই লিখিত হয় কবিতা, তার সাথে যুক্ত হয় ভাষাশৈলী । এই বইটিতে কবি আমাদের বেশ কিছু সত্ত্বার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন, যাতে কখনো কখনো মনে হয় প্রতিটি সত্ত্বা তার দ্বারা যাপিত এবং সম্ভবত তা-ই । বইটির কিছু কিছু কবিতা জিজ্ঞাসামূলক আবার কিছু কিছু অনুধাবনমূলক বক্তব্য যেন অথবা অভিজ্ঞতার বিমানবিক প্রকাশ । 'অছ্যুত' কবিতাটিতে কবি লিখেছেন- "একটা সাদা সিধা ঘড়ি চাই, উল্টো চাকা...মায়ের গর্ভ থেকে আরও আরও গভীরে নিয়ে যাবে, যেখানে আলো মরে আছে", এখানে তার কৌতুহল স্পষ্ট ফুটে ওঠে, আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে এক গাঢ় যোগাযোগ যেন, আবার যখন পড়ি "কামরূপ কামাক্ষা থেকে কতো-কতোদূর নীলাচল?" এখানে বিরাগ পাই জীবনের, দূর নিসর্গ ভিতরে ভিতরে ডেকে চলেছে যেন তার । একটা কবিতা পড়া যাক এখন...

কাঠচুরি
এখানে জঙ্গলে কাঠচুরি হতে পারে,
এ-কথা সকলে জানে।
চোলাই আর আনারসে নেশা হয়ে গেলে
তাগড়া মেয়েমানুষেরাও ঘুমিয়ে পড়ে।
তারপর টর্চ আর লাঠি হাতে
চোরাপথে ঢুকে পড়ে অশুভ কাঠুরে;
চলে চিরুনি-তল্লাশ।
কী ভীষণ দূর্গম পথ ও অন্ধকার!
*
যেভাবে জঙ্গল সাফ করে
বিশুদ্ধ হতে চায় মানুষ,
সেই লুক্কায়িত গন্দমের খোঁজে
শহর থেকে নিরাপদ দূরত্বে
আর জঙ্গল থেকেও দূরে
চেকপোস্ট বসানো আছে

বইটির 'জাদুকর' কবিতায় খুব চমৎকার একটি কথা আমরা লক্ষ্য করি,

আমরা যে সুখের দিনগুলোর কথা ভেবে থাকি, সেখানে বিমূর্ত থাকে হারানোর দুঃখবোধ ।

যদিও তা অভিনব নয়-নাগরিক দুঃখবোধের প্রকাশ, যেখানে অলীক বা খণ্ডকালীন সুখের বলয় দিয়ে ঘিরে থাকে দুঃখবোধ, কবির যাপন প্রকাশিত হয় মার্জিত ভাষাশৈলীর মাধ্যমে । আধুনিক কবিতা যে বিমানবিকীকরন চায়, তা বোধয় এখানে কিছুটা সাফল্য পায় ।

সমুদ্রকে ছুঁয়ে
সমুদ্রকে ছুঁয়ে দেয়া যেতে পারে।
এরূপ নিদানে বহুরূপী গাঢ় নিঃশ্বাসে
শ্যামলিমা, তুমি হাওয়ার সাথে
নাগরিক ফিসফাস থেকে দূরে
বালি আর ঝিনুকের বনে
ভেসে আছো নিরব গভীর অন্ধকারে।
দুধেল ফেনায় চড়ে সংকেত আসে,
যেন সুদূরবর্তী কোনো জাহাজে
এক অচেনা ইমেজ সুর তুলে আছে;
তোমার বাসনা জাগে সেই অদেখার
কাছে। পেছনে বিষম আগুনের কথা
ফেলে, শূণ্য কিশলয়ে সাগরের ধারে
এতগুলো কিসের মুখোশ? সেই নীল নীল
পৃথিবীর শিয়রের পাশে তুমি ভেসে আছো শূণ্য হাহাকারে।

এই কবিতায় এক অচেনা ইমেজের কথা কবি বলেন, তা কি ধাঁধা? তা কি বাস্তব? এই প্রশ্ন আর সন্দেহ একইসাথে দেখতে পাই কবিতায় । যেখানে কবি একই সময় এক হাহাকার প্রকাশ করেন এবং তাকেই খোঁজেন প্রকৃতিতে, নগর বিমুখতা যেখানে স্পষ্ট । পুরো বইটি জুড়েই আমরা এক প্রকার অল্টার ইগোর খোঁজ পাই, যেখানে একইসাথে বৈরাগ্য রয়েছে আবার রয়েছে গার্হস্থ্যের দিকে যেতে চাওয়ার বাসনা। বইটিতে অভিনব ভাষা তৈরীর কোনো সচেতন চেষ্টা লক্ষ্য করা যায় না, তিরিশের দশকের আধুনিকতা এবং পরবর্তীতে ধীরে ধীরে এক আধটু এলিমেন্টস এর যে সূত্র তা ধরেই কবি তার কবিতাগুলোতে এগিয়েছেন, ফলে শৈলীর দিক থেকে পাঠক সন্তুষ্টির জায়গাটা কিছুটা অপূর্ণই থেকে যায়, যদিও পাঠকের সন্তুষ্টির চেয়ে বাঙলা কবিতায় সংযোজনের গুরুত্বই বেশি, সেই গুরুত্বও বোধয় কিছুটা অরক্ষিত হয় পুরো বই জুড়ে । কিছুটা বিশৃঙ্খলাও লক্ষ্য করা যায় ভাষা নিয়ে । কোনো কোনো কবিতায় পরিমার্জনের অভাব । যে কারণে 'পকেটে চাকু' কিংবা আসছে ফাগুন কবিতায় বিস্তর দূরত্ব লক্ষ্য করা যায় টাইমফ্রেমের, যেন একটি আরেকটির চেয়ে কমপক্ষে দুই দশক টাইমফ্রেমের দূরত্বে অবস্থান করছে । এই বইয়ের আরেকটি কবিতা পড়া যাক

ভালুক
রাতুলদা, ভালুকের সাথে মাঝরাতে দেখা হয়ে
গেল। কীভাবে আমি শুয়ে থাকি, জেগে থাকি
এধরনের তথ্যগুলো নিয়ে শর্ট-ফিল্ম করবে আশা
করি। ভালুকের মনের কথা ও রস আর গন্ধে
কেমন নেশাগ্রস্ত অনুভূতি। ময়ূরের পালকে কিছু
গল্প সাজিয়ে রেখে আলমিরা বন্ধ রাখা ভালো।
জানো রাতুলদা? ছেলেবেলায় ভাবতাম, বইয়ের
ভাঁজে পালক রাখলে তা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে।
মগজের ভিতর একটা ভ্যাম্পায়ার সারাদিন জোকস
বলে। আমি দীর্ঘ সময় নিয়ে হাসি। কোনো শব্দ
নয়, তরবারির ফলার মতন ঘাতক রশ্মি। তাহার বাগানে
দুটো ফুল আছে জানি। ঠিক মাঝরাতে আমার মনে
পড়ে, বড় দীর্ঘ নিঃশ্বাসে কেটেছে সারাটাদিন।
চুরি করার বাসনা জেগেছে। সারাদিন শুধু ফুল আর
তাকে যৌথ চুরির ব্যর্থ মনোরথ সাজিয়েছি ।
'ছোটবেলায় ভাবতাম, বইয়ের ভাঁজে পালক রাখলে
তা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে',

এই কবিতার অনেকগুলো ইমেজ পরপর সাজানো, এগুলো যে কোনো প্রতিবর্তক্রিয়া নয় তা বোঝা যায় কবির বক্তব্য থেকেই, যেখানে সচেতনভাবে কবি বলছেন তার 'মগজের ভিতর একটা ভ্যাম্পায়ার সারাদিন জোকস বলে' । আবার মেথরপট্টির জনৈক যুবক কবিতায় কাম ও প্রেমরেও আমরা দেখি যুগপৎ ফুটানোর প্রচেষ্টায় আদতে যদিও ওরা যুগপতই থাকে, সেখানে ভাষাটা আমার কিছুটা পূর্বদের অনুসরণ করে, যা আসলে কবিতার ডিমান্ডের কাছে কিছুটা অগ্রহণযোগ্য । সব মিলিয়ে আমি বলবো 'বৃক্ষরোপণ গান' একটা সন্দেহজনক বই, এই বই পড়ুন এবং সন্দেহ করুন আর মানুষের মানবসত্ত্বা, অতিমানবসত্ত্বা, এবং পশুসত্ত্বাকে বুঝতে নিজেকে প্রস্তুত করুন । শুভকামনা কবি অসীম নন্দনের জন্য...


মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ