নৈঃশব্দ্যের নরোম বুক - বিটুল দেব

বিটুল দেব'র 'নৈঃশব্দ্যের নরোম বুক': আপন দর্পণে সময়ের প্রক্ষেপন
ইয়ার ইগনিয়াস
নৈঃশব্দ্যের নরোম বুক - বিটুল দেব

নৈঃশব্দ্যের নরোম বুক
বিটুল দেব

প্রচ্ছদ: দেবাশীষ মজুমদার
প্রকাশ কাল: অমর একুশে গ্রন্থমেলা '১৮
প্রকাশক: শাঁখ প্রকাশন
দাম: ১২০টাকা।

অপ্রতুল প্রত্যয় ও সুকান্ত-বয়সী সাহস সঞ্চয় করে পাঁজরের পরিধি হালকা ফুলিয়ে নতুন শতাব্দীর শুরুতেই কাব্যদেবীর প্রেমে পড়েন বিটুল দেব। চলতি বছরেই অমর একুশে গ্রন্থমেলায় শাঁখ প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে 'নৈঃশব্দ্যের নরোম বুক' নামে তার প্রথম কবিতাপুস্তিকা। গ্রন্থনাম পড়েই বুঝা যায় কবি কতোটা নৈঃশব্দ্য নীরবে পুষেন। তিনি নৈঃশব্দ্যে জারিত হন। যাপনের বিবিধ বিষয়কে ব্যক্তিগত প্রিজমে রেখে বহুবর্ণিল আলোকরেখায় দেখেন, বিশ্লেষণ করেন। সহজাত সৌন্দর্য ও যাবতীয় অসঙ্গতি তার কবিতার বিষয়। মিথ-পুরাণ-লোকধর্মের বিষয়গুলিও তার কবিতায় সাবলীল প্রকাশ পেয়েছে। তার দর্শনেও নেই দ্বান্দ্বিকতা । নিজস্ব স্বর তৈরী করতে কবি ঝাঁপ দেন বিষয় থেকে বিষয়ে। তার কবিতা বর্ণনাধর্মী, অথচ কী নিপুণ সংহত সম্পাদনা অবাক করা ব্যাপার! সমুদয় অনিয়ম-অন্যায়-অসঙ্গতি গা সওয়া হয়ে গেছে যাদের। কিছুতেই নড়ে না বিবেকের কড়া। সবাক মন হয় না অবাক। তাদের জন্য এ বই অভিনব ও তরতাজা টনিক। প্রিয় পাঠক চলুন কিছুটা অবাক হয়ে আসি...
মাটি যদি ফসলের মা হয়
অাগাছাও মাটির সন্তান।
তবে কেন? সমাজ লাথি মেরে ভাঙে
বৃহন্নলার নরোম বুক?
(বৃহন্নলার বিষাদ, পৃ-১৩)
এখানে কবি অনাথ ও পথ-শিশুদের কথা বলেছেন। কথিত সমাজ যাদের মানুষ পরিচয় দিতে কার্পণ্য ও কুন্ঠাবোধ করে। যাদেরকে পরোক্ষে যাবতীয় অনৈতিক কাজে খাটায় এবং প্রত্যক্ষে শুনায় সুনীতির কবিতা। সভা-মজলিসে তাদের বংশ উদ্ধার করে এবং জঘন্য সাজা দিতে ও বুক কাঁপে না। কেড়ে নেয় স্বাভাবিক বাঁচার অধিকার। স্বঘেোষিত ও স্বৈরাচারী এরূপ সমাজপতির অভাব নেই রঙ্গ ভরা এই বঙ্গদেশে। তা-ই গোচরে আনতে চেয়েছেন কবি।

যুগে যুগে কবি-ই মসী হাতে শশীর আলো হয়ে তাড়িয়েছেন জড় পৃথিবীর জঘন্য জাহেলিয়া সমগ্র। একুশ শতকের কবি বিটুল দেবও তার ব্যতিক্রম নয়। তার কবিতায় প্রচল পৃথিবীকে গুড়িয়ে দেয়ার আওয়াজ শুনতে পাই। তিনি ভেঙে দিতে চান সমস্ত কুসংস্কার ও গগনচুম্বী অনিয়ম। আর তা ভাঙতে গেলে যে অপমান ও বিদ্রূপ সহ্য করতে হবে তাও তার আছে জানা। তবুও স্বপ্ন দেখে, সে এক হেঁটে যাবে জঞ্জালহীন জনপদে। কেননা এই স্বপ্নভুক কবি জানেন, বিপ্রতীপ ভাবুকেরা যতই সংখ্যাগরিষ্ট হোক সংখ্যালঘুরা-ই জিতেছেন বারবার। ধর্মপ্রচারকরা বরাবর সংখ্যালঘু-ই ছিলো! তাই কবি উচ্চারণ করেন -
সরল বুক দৈনিক উপহার পাই ব্যঙ্গাতকের হাসি
দেহ ছায়া ফেরারী করে চলে গোপন অভিমান!
তবু একদিন কঠিন মৃত্তিকা ভেদ করে উঠবে
পৃথিবীর বুকে সবুজ উদ্ভিদ...
(ব্যঙ্গাতকের হাসি ও আগামীর স্বপ্ন, পৃ- ২৩)
তিন ফর্মার এই বইটিতে স্থান করে নিয়েছে বিভিন্ন সময়ে রচিত চল্লিশটি কবিতা। কবি তো মূলত প্রেমিক। সাধারণ কিছুও তার চোখে বাজে গীটারের রিডের মতো ছয় ব্যঞ্জনায়। তাই কবিতাগুলোতেও মানবপ্রেম-প্রকৃতিপ্রেম-স্বদেশপ্রেম বারবার এসেছে নব নব মাত্রায়। তবে পড়ে ফেলি তুমুল প্রেমের ক'ফোঁটা পংক্তি -
চোখের মতো যদি দান করা যেতো আয়ুষ্কাল/তাহলে নিমিষে দান করে দিতাম পরাণ বায়ু"
(যদি দান করা যেতো আয়ুষ্কাল,পৃ-২৭)
"নার্স, তোমার হাসিতে সেরে যায় অর্ধেক রোগ আর অর্ধেক ঔষধে! তোমার ভালোবাসা পেলে আমার পরিবর্তে যমদূতকে পাঠাতে পারি মৃত্যুর পথে।
(হাসিতে সেরে যায় অর্ধেক রোগ, পৃ- ৩৪)
সত্তরের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করেও ক্ষমতায় বসতে পারেন নি বঙ্গবন্ধু। পাক-সরকার দুরভিসন্ধি করে রাতের অাঁধারে হামলে পড়ে অতর্কিত। শুরু হয় মু্ক্তির সংগ্রাম। আর পাক সেনারা অধর্ম ও অপকর্ম জেনেও যুদ্ধের ছলে সুযোগ বুঝে হাত দেয় মা-বোনের ইজ্জতে। শুরু হয় রজনী-রাঙা রক্তপাত। শত সহস্র তমাল তরুণের রক্তে ভিজে যায় বাংলা মায়ের শতরঞ্জি। এক সময় বিজয় লাভ করেও লাভ হয়নি এদেশের। দেশীয় শকুনের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নির্মম নিহত হলো। ফলে আলোর দিশা দেখানোর মত কেউ রইলো না আর। আমাদের পৃথিবী দূর ভবিষ্যতেও ঘোর অন্ধকারে পর্যবসিত! এই চরম সত্যও উঠে এসেছে বিটুলের কবিতায়। কবিতার শুরুটা এরকম -
শকুনী চোখে জ্বলে ক্রোধের আগুন! অধর্মে-অপকর্ম হলেও হারাবে না সাম্রাজ্যের রাজ মুকুট। পাশা খেলায় কৌশলে বসায় কুচক্রীয় অভিসন্ধির সভা। বারে বারে জোড়া গুটিতে বৃহত্তর সংখ্যায় অশ্লীল হাসির জোয়ার। ছলের চালে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ আর অভিমুন্য'র অকাল মৃত্যুতে ঘোর অন্ধকার!
(ক্ষুদ্র কুরুক্ষেত্র, পৃ-১৬)
সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে গেছে সবচেয়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞ। রাখাইনদের ওপর নাৎসীরূপী নাসাকার বর্বরতার অত্যাধিক অত্যাচার। বাংলাদেশের দক্ষিণ সীমান্ত দূষিত হয়ে গেছিল পঁচিত লাশের গন্ধে। কেঁদে কেঁদে কেঁপে ওঠেছিলো বিশ্ব মানবতা। 'শুধুই মানুষ' কবিতায় কবি এমনটি বলেছেন -
নাফের নদীতে ভাসে গলিত লাশের ভেলা!
শরীর পঁচা গন্ধ মিশেছে লোনা জলে
ঘৃণা জন্মছেন পৃথিবীর সকল হৃদয়ে

কোন ধর্ম কোন জাতিকে সনাক্ত করি না
শুধু মানুষ, শুধু মানুষ ওহিসেবে আর্তচিৎকার।
রোদের ঘ্রাণ নিয়ে এগোতে এগোতে বেশ কিছু ভাল লাগা কবিতা পেয়েছি। এরমধ্যে 'কাল সাপের মুখ' ' লবণের জীবন' 'অপমানের ইতিহাস' 'দরিদ্র বর্ষা' পাহাড়, 'পাখি ও গাছের আর্তনাদ' 'পারিবারিক ব্যাংক ও সূর্যমেলা' 'বৃষ্টির ফুল' কবিতাগুলো অন্যতম। আশাকরি বইটা পাঠকপ্রিয়তা পাবে। ভবিষ্যতে কবি আরও ভালো কবিতা উপহারে দিয়ে বাংলা সাহিত্যের আকাশে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে সক্ষম হবেন আশাকরি। কবিতার সাথে থাকুন, কবিতার জয় হোক....

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ