রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ - তপন বাগচী


রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ - তপন বাগচী
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ
তপন বাগচী
প্রচ্ছদ: কাইয়ুম চৌধুরী
বাংলা একাডেমী
প্রকাশকাল: ১৯৯৮
পৃষ্ঠা: ২১৪
মূল্য: ৭০/=
ISBN: 984-07-3777-5

বাংলা একাডেমীর জীবনী গ্রন্থমালা প্রকল্পের আওতায় 'রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ' বইটির প্রকাশ। জীবনী গ্রন্থের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপাদান এই বইতে রয়েছে। কবির জীবন, শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন; প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের তালিকা ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ; তার সম্পর্কে অন্যদের মন্তব্য; বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য রচনার নিদর্শন ইত্যাদি দিয়ে সাজানো এই বই বেশ তথ্যবহুল। সাহিত্য ও ইতিহাস নিয়ে গবেষণায় আগ্রহীদের নিকট প্রয়োজনীয় উপাদান এই বইয়ের গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে বাংলা একাডেমীর এই সশ্রদ্ধ নিবেদন সত্যি প্রশংসাজনক।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ছিলেন সত্তর দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। কাব্যচর্চার পাশাপাশি সঙ্গীত, নাটক, ছোটগল্প রচনাতেও তিনি সমান উৎসাহী ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠুক। আর তাই রুদ্রের সমস্ত শিল্প সাধনা ছিল দেশ, মানুষ ও মনুষ্যত্বের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ। ১৯৫৬ সালের ১৬ই অক্টোবর যে শিশুটি বরিশালের রেডক্রশ হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন, বাংলা ভাষার কাব্যজগতে নতুন মাত্রা ও ধ্বনিময়তা যোগ করে ১৯৯১ সালের ২১ জুন ভোরবেলা মাত্র পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়সে তিনি লোকান্তরিত হন।

‘জাতির পতাকা খামচে ধরেছে সেই পুরনো শকুন', ‘ বাতাসে লাশের গন্ধ' প্রভৃতি পাঠকপ্রিয় বহুল উচ্চারিত পংক্তিমালার রচয়িতা ছিলেন তিনি। দেশ ও জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের আলোকে নতুন আকাঙ্ক্ষায়  জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব একাই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তাই তাঁর কাব্যে পাই দ্রোহের নতুন সুর; নতুন মানবিক বোধ ও সমাজ কাঠামোর জয়ধ্বনি।

আলোচ্য জীবনীগ্রন্থের সূচীপত্রটি একবার দেখে নেয়া যাক।
  • জীবন-কথা
  • পরিবার পরিচিতি
  • শিক্ষাজীবন
  • সংসার জীবন
  • কর্মজীবন
  • সাময়িকপত্র সম্পাদনা
  • কতিপয় চরিত্র বৈশিষ্ট্য
  • শেষজীবন ও মৃত্যু
  • রচনাপঞ্জি পরিচিতি
  • সমকালীন প্রতিক্রিয়া
  • জীবন দর্শন ও সাহিত্য বৈশিষ্ট্য
  • রচনা নিদর্শন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স করা রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ বাংলা সাহিত্যে নতুন স্বর যোগ করেছেন। চেতনায় প্রতিবাদের আগুন নিয়ে তিনি পোড়াতে চেয়েছেন সমাজের যত জঞ্জাল। কিন্তু তাঁর কাব্যপ্রতিভার পূর্ণ বিচ্ছুরণ বাংলা সাহিত্যের ললাটে ছিল না। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে নতুন সমাজ বিনির্মাণে তাঁর কাব্য দেশের তরুনদেরকে নতুন দিশা দেখিয়েছিল; শিখিয়েছিল দেশপ্রেমের নতুন গান।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ তাঁর জীবদ্দশায় সাতটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। সেগুলো হল:
১। উপদ্রুত উপকূল। ১৯৭৯
২। ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম। ১৯৮১
৩। মানুষের মানচিত্র। ১৯৮৪
৪। ছোবল। ১৯৮৬
৫। গল্প। ১৯৮৭
৬। দিয়েছিলে সকল আকাশ। ১৯৮৮
৭। মৌলিক মুখোশ। ১৯৯০
তবে তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরে ১৯৯২ সালে প্রকাশ হয় কাব্যগ্রন্থ 'এক গ্লাস অন্ধকার' ও নাট্যকাব্য 'বিষ বিরিক্ষের বীজ'।

রুদ্র রচিত ৫৩টি গানের শিরোনাম এই বইতে রয়েছে। তাঁর স্বহস্তে লিখিত কবিতার পাণ্ডুলিপি, মা ও স্ত্রী তসলিমা নাসরিনকে লেখা দুইটি চিঠির চিত্রলিপি এই বইয়ের অন্যতম আকর্ষণীয় উপাদান।

রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রধান কবিগণ বিভিন্ন উপলক্ষ্যে মন্তব্য করেছেন। সেগুলো বিভিন্ন আলোচনায় প্রসঙ্গ বুঝে প্রকাশ করা হয়েছে।

তাঁর সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রধানতম কবি 'শামসুর রাহমান' বলেছেন-
এই তরুণ কবির মধ্যে এক ধরনোর বাউণ্ডুলেপনা ছিল, যা তাঁকে সুস্থির হতে দেয়নি, নিজেকে পুড়িয়েছেন আতশবাজির মতো। যারা এই দৃশ্য দেখে তাদের কাছে সেটা মনোহর, চিত্তাকর্ষক মনে হয় কিন্তু যে পোড়ে তাঁর পক্ষে এই জ্বলতে থাকা অত্যন্ত যন্ত্রণাময়।
তাঁর বিভিন্ন কাজ ও আবেগতাড়িত আচরণসমূহের প্রশ্রয়দাতা কবি ‌‍'নির্মলেন্দু গুণ' বলেছেন-
রুদ্রের অহেতুক কিছু কাজকর্মে আমি ও উপর রাগ হতাম এবং না-করার জন্য বলতাম তবে বয়সে তরুণ হলেও আমার একান্ত বন্ধু ছিল। অসীম সাহার ছাপাখানায় রুদ্রের আড্ডায় আমিও অংশ নিতাম। আমার ভালো লাগছে ওর জীবদ্দশায় মুহম্মদ নূরুল হুদা ও রুদ্রকে আমার সর্বশেষ প্রকাশিত কাব্যখানি উৎসর্গ করেছিলাম।
কবি 'মহাদেব সাহা' ছিলেন ষাটের দশকের জনপ্রিয় কবি। তিনি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ সম্পর্কে বলেন-
রুদ্র সবসময়ই ছিল অসম্ভব রকম জীবন্ত ও সক্রিয়। নানা আগ্রহ ও কৌতূহল আকর্ষণ করতো তাকে। তার মধ্যে হয়তো কিছু কিছু অবান্তর ও অপ্রয়োজনীয় আগ্রহও ছিলো। এই সব আগ্রহ, কৌতূহল ও উদ্যমের মাত্রা কিছুটা প্রশমিত হলে তার কাব্যজীবনই সম্ভবত লাভবান হতো।
বিভিন্ন প্রসঙ্গে রুদ্র সম্পর্কে আরো যে লেখক-সাহিত্যিকগণের মন্তব্য এই বইয়ের বিভিন্ন পাতায় রয়েছে তারা হলেন 'আবু বকর সিদ্দিক', ‘রফিক আজাদ', ‘ফরহাদ মজহার', ‘মাহবুব সাদিক', ‘সাযযাদ কাদির', ‘কাজী রব', ‘আবিদ আনোয়ার', ‘নাসির আহমেদ', ‘আলম মেহেদী', ‘ইসহাক খান', ‘আবু হাসান শাহরিয়ার' প্রমুখ।

রচনা নিদর্শন হিসেবে বেশ কয়েকটি কবিতা ও গানের পাশাপাশি তাঁর বহুল আলোচিত প্রবন্ধ "‘নব্য জসীমিজম’ ও বহমান লোকধারা" শীর্ষক প্রবন্ধটিও তুলে দেয়া হয়েছে। রয়েছে চারটি সাক্ষাৎকার। 'সোনালী শিশির', ‘ইতর', ‘নিঃসঙ্গতা', ‘উপন্যাসের খসড়া’, ‘যেখানে নরকে গোলাপ’ ছোটগল্পগুলো সম্পূর্ণ তুলে দেয়ায় আগ্রহী পাঠক উপকৃত হবে।

সবশেষে রয়েছে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ'র কয়েকটি বই ও সাময়িকপত্রের প্রচ্ছদচিত্র।

আলোচ্য বইটি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহকে চিনতে, তার মনন, দর্শনবোধ, কাব্যচিন্তাকে অনুধাবন করতে বেশ সহায়ক হবে। রুদ্র সম্পর্কে অনভিজ্ঞ পাঠকের মর্মে তাঁর যথাযথ চিত্র রূপায়নে এই বই সম্পূর্ণভাবে সফল হয়েছে বলে মনে করি।

ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলা একাডেমীর পক্ষ থেকে দেশের প্রথিতযশা সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিল্পীদের জীবনালেখ্য প্রকাশ করার এই ধারা বর্তমানে ক্ষীয়মান। সমকালীন সময়ে বাংলা একাডেমী এরূপ আর একটি প্রকল্প হাতে নিতে পারে। তাহলে পাঠক সমাজ নতুন বরেণ্য ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিত হতে পারবে।

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ