৫০৬ প্রজাতির পাখি চিনতে পড়ুন ‘ইনাম আল হক’ এবং ‘তারেক অণু’ রচিত “বাংলাদেশের পাখির ফিল্ড গাইড”

‘ইনাম আল হক’ এবং ‘তারেক অণু’ রচিত “বাংলাদেশের পাখির ফিল্ড গাইড”
বাংলাদেশের আবহাওয়া পাখিদের জন্য আরামদায়ক। খুব বেশি গরম বা ঠাণ্ডা কোনটাই নেই। এই নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ সবধরনের পাখিকে আকর্ষণ করে। সারাদেশে জালের মত বিছানো নদীগুলো অফুরান খাদ্য ও পানীয় জলের উৎস। বাংলাদেশের প্রাণবৈচিত্র্য ৭০০রও বেশি প্রজাতি নিয়ে পাখিসম্পদে ধনী বললে অত্যুক্তি হয় না।

দুরবিন কিংবা টেলিস্কোপ দিয়ে অথবা খালি চোখে দেখে প্রকৃতিতে পাখি চেনার চেষ্টা করা একটি জনপ্রিয় শখ।
এত ব্যাপক সংখ্যক বৈচিত্র্যময় পাখিদের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার মত বই বাংলা ভাষায় খুব একটা নেই। বিখ্যাত পাখিপ্রেমিক ‘ইনাম আল হক’ ও সৌখিন পরিব্রাজক ‘তারেক অণু’ বাংলাদেশ সীমান্তে দৃশ্যমান পাখিদের সাথে উৎসাহী পাঠককে পরিচয় করিয়ে দিতে চান। আর এ জন্য রচনা করেছেন “বাংলাদেশের পাখির ফিল্ড গাইড”

পাখি সম্পর্কিত অন্যান্য বইয়ের মত এই বইটিও বর্ণিল; বহু বিচিত্র প্রকারের পাখির ছবি শোভিত। মূল বইয়ের ভিতরের পাতা ওল্টানোর আগে সূচিপত্রে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়া যাক। এখানে মোট ৬৫টি পাখির নাম আছে। প্রত্যেক পাখির রয়েছে একাধিক প্রজাতি। পরিচিত পাখিগুলির প্রত্যেকের বর্ণনা, একাধিক ছবিসহ উল্লেখ করা হয়েছে। বইটি সম্পর্কে 'প্রকাশক ও লেখকের নিবেদন' অংশে বলা হয়েছে-

দুরবিন কিংবা টেলিস্কোপ দিয়ে অথবা খালি চোখে দেখে প্রকৃতিতে পাখি চেনার চেষ্টা করা একটি জনপ্রিয় শখ। নানা ধরনের গবেষণা-কাজেও এর প্রয়োজন হয়। হাতে একটি ফিল্ড-গাইড থাকলে পাখি চেনার কাজটি সহজ তো হয়ই, অনেক বেশি উপভোগ্যও হয়।… বইটি লেখার জন্য আমরা উপমহাদেশের পাখি নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন বই ও বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধের সাহায্য নিয়েছি। দুই দশক ধরে বাংলাদেশে পাখি দেখা ও পাখিশুমারি করার অভিজ্ঞতাও এ ক্ষেত্রে কাজে এসেছে।… বাংলাদেশে সচরাচর দেখা মেলে এমন ৫০৬ প্রজাতির পাখি এখানে বর্ণনা করা হয়েছে। আমাদের দেশের বন্যপ্রাণীর তালিকায় আরো দেড় শত প্রজাতির অনিয়মিত আগন্তুক ও অতি-বিরল পাখি আছে। দীর্ঘ অধ্যাবসায়ের পর অথবা ভাগ্যক্রমে অমন কয়েকটি পাখির দেখা জীবনে মিললেও মিলতে পারে। সে সব পাখির বর্ণনা এই ফিল্ডগাইডে দেয়া হয়নি।

বইয়ের ভিতরে প্রবেশ করলে অবাক হয়ে যেতে হয়। বাংলাদেশে এত বর্ণবৈচিত্র্যের বিভিন্ন রূপের পাখি যে দেখা যায় তা অনেকেই হয়তো জানেন না। এই বইয়ে পাখিগুলোর পরিচয় বেশ অভিনব উপায়ে দেয়া হয়েছে। পরিচিতি দিতে গিয়ে আলোচিত পাখির নাম উপরে লিখে নিচে একটি রঙিন বক্সে পাখিটি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা লেখা হয়েছে। এর পরপরই রয়েছে ছোট ছোট টীকা বা অনুচ্ছেদের আকারে ওই পাখির বিভিন্ন প্রজাতির বিবরণ। রয়েছে ব্যাকরণ বিবর্জিত ছোট ছোট বাক্যে ওই প্রজাতির পাখির বিভিন্ন দিকের বর্ণনা। আকার ও অবয়ব, দৈর্ঘ্য, শরীরের কোথায় কেমন রং, মাথার রং, ঠোটের- চোখের- লেজের রং আকার ও সাইজ কিরকম, ডাকে কেমন করে, কী খায়, আচরণ এবং অভ্যাস কীরূপ, কোন জেলায় কতটা সহজে দেখা পাওয়া যায় – এরকম বিভিন্ন তথ্যে পাখিটিকে সহজে চিনে ফেলা যায়। পাশের পৃষ্ঠায় সবকটি প্রজাতির প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ ও অপ্রাপ্তবয়স্ক বাচ্চা, উড়ন্ত বা বসা অবস্থা এরূপ বিভিন্ন ভঙ্গিমার রঙিন ছবি দেয়া হয়েছে। পাঠক সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ও ছবিগুলো দেখেই পাখিটিকে চিনে নিতে পারবেন।

সূচিপত্র ও পাখির দৈহিক পরিচিতি
সূচিপত্রের পরের পৃষ্ঠায় রয়েছে পাখির দৈহিক পরিচিতি। পাখি দেখতে হলে পাখির প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে চিনতে হয়। কারণ অনেক প্রকারের পাখির শরীরের বিভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন রঙের প্রলেপ থাকে। ঠোঁট, চোখ বা পায়ের গঠন, দৈর্ঘ ও রঙেও থাকে ভিন্নতা। পাখি চিনতে হলে সেসব বুঝতে হয়। কোন অঙ্গের কী নাম তা জানতে হয়। এসব না জানলে কোন কম পরিচিতি পাখিকে দেখেও ঠিকমত বর্ণনা করা কঠিন হয়ে পরে। সে জন্য পাখির শরীরের ছবি দিয়ে তার কোন অঙ্গের কী নাম তা উল্লেখ করা হয়েছে। 'পাখির বর্ণনায় বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের নাম" শীর্ষক পৃষ্ঠায় পাখির শরীর ও মাথার ছবি দিয়ে বিভিন্ন অংশের নাম লিখে দেয়া হয়েছে। উৎসাহী পাখিপ্রেমীগণ এই পাতা থেকে অনেক উপকৃত হবেন।

বইয়ের সূচনায় বাংলাদেশের ম্যাপ ছাপিয়ে সেখানে পাখিদের প্রধান আবাস যেসব জায়গায় তা চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে। বইয়ের শেষে পাখিদের বাংলা, ইংরেজি ও বৈজ্ঞানিক নাম বর্ণানুক্রমিকভাবে ছাপানো হয়েছে। এই অংশটি সংযোজন করা বেশ বুদ্ধিদীপ্ত কাজ হয়েছে। পাঠক এখান থেকে সহজেই কোন পাখির নাম জেনে নিতে পারবে।


বইয়ের কিছু অংশে কয়েকটা বিষয়ে একটু খটকা লেগেছে। সেগুলো এক এক করে উল্লেখ করা যেতে পারে।
  • একঃ কোন পাখিটি অতিথি বা পরিযায়ী পাখি তার কোনরকম উল্লেখ নেই। কোনরকম চিহ্ন বা বর্ণ দিয়ে বা এক কথায় 'পরিযায়ী' শব্দটি লিখে দিয়ে হলেও বোঝানো যেত। কিন্তু তা করা হয় নি। ফলে পাঠক পাখিটিকে চিনতে গিয়ে বিভ্রান্ত হতে পারেন যে এটা পরিযায়ী না স্থায়ীভাবে বসবাস করা আবাসিক পাখি।
  • দুইঃ বইয়ের যেসব পাতায় পাখিদের ছবি রয়েছে তার কোন কোনটির ব্যাকগ্রাউন্ড রঙিন। ৪৭, ৫৩, ১৪১ নং পৃষ্ঠাসহ বেশ কয়েকটি পৃষ্ঠা সম্পূর্ণ রঙিন। এর কোন ব্যাখ্যা কোথাও লেখা নেই। কী কারণে এই পৃষ্ঠাগুলো রঙিন তা কোন জায়গায় লেখা থাকলে পাঠকের মনে কোন প্রশ্নের উদয় হত না।
  • তিনঃ পাখিদের বর্ণনা দিতে গিয়ে পাখির নামের পরে একটি রঙিন বক্সে সেই পাখি সম্পর্কে কয়েকটি বাক্য লেখা হয়েছে। এই রঙিন বক্সগুলো বিভিন্ন রঙে রাঙানো। কোনটা নীল, কোনটা সবুজ, এছাড়াও হলুদ, খয়েরি, বাদামী, আকাশী বিভিন্ন রঙের রয়েছে। এর কারণ কী? কী উদ্দেশ্যে বা চিহ্নিত করার জন্য এরকম বর্ণবৈচিত্র করা হয়েছে- তা কোথাও লেখা নেই। এরকম হতে পারত যে জলচর পাখিদের বর্ণনায় নীল রঙ বা সমুদ্রের পাখি, নদীর পাখি, বনের পাখি ইত্যাদি পাখির জন্য আলাদা আলাদা রঙ– তা কিন্তু নেই। সেরকম কোন সচেতন প্রয়াস লেখকদ্বয়ের চিন্তায় ছিল বলে মনে হয় না। পরবর্তী সংস্করণে এই বিভ্রান্তিগুলো দূর করা যেতে পারে।

 

যারা পাখি দেখতে ঘর ছেড়ে বের হবেন, তাদের হাতে এই বই অবশ্যই থাকতে হবে।
সার্বিকভাবে বলা যায়, ‘ইনাম আল হক’ এবং ‘তারেক অণু’ রচিত “বাংলাদেশের পাখির ফিল্ড গাইড” বইটি খুবই উন্নতমানের। সব দিক দিয়েই। বইয়ের ছাপানো, সাজানো, ছবি সংযোজন, ভাষাভঙ্গি, তথ্যের উপস্থাপন সব কিছুই প্রশংসাযোগ্য। পৃষ্ঠাগুলো চকচকে সাদা, ছবিগুলো চাররঙে নিখুঁতভাবে ছাপানো, লেখার রং গাঢ় কাল, বাঁধাই পেপারব্যাক। এই বইয়ের প্রত্যেকটা পৃষ্ঠা চাররঙে ছাপানো। সেজন্যই হয়তো দামটা বেশি। তবে এটা ঠিক যে, পেপারব্যাক বাঁধাই না করে যদি মলাট বোর্ড বাঁধাই করা হত, তাহলে দাম আরও বেশি হত। লেখকদ্বয় বইতে যে ছবিগুলো ব্যবহার করেছেন, তা সংগ্রহ করেছেন Christopher Helm প্রকাশিত THE POCKET GUIDE TO THE BIRDS OF THE INDIAN SUBCONTINENT বই থেকে। ছবিগুলো এঁকেছেন বেশ কয়েকজন অংকন শিল্পী। এদের সবার নাম ও নিজেদের বইয়ে ছবিগুলো পুনঃপ্রকাশের অনুমতি পত্র লেখকগণ সকৃতজ্ঞচিত্তে প্রকাশ করেছেন। এরকম বিনয় বাংলাদেশে বসবাসরত লেখকদের মধ্যে বিরল। তারা বহুদিন বিদেশে ছিলেন বলেই বোধহয় এরকম কৃতজ্ঞতা স্বীকারের নীতিবোধটি অনুধাবন করতে পেরেছেন।

পাখির পরিচিতি ও ছবি
যারা পাখি দেখতে ঘর ছেড়ে বের হবেন, তাদের হাতে এই বই অবশ্যই থাকতে হবে। পাখি দেখতে গিয়ে কোন পাখি তার অপরিচিত থাকবে না একথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। বাংলাদেশ ভূখণ্ডে দেখা যায় এমন পাখিদের নিয়ে এরকম তথ্যবহুল বই প্রকাশ করার জন্য লেখকদ্বয়কে অশেষ ধন্যবাদ। প্রচ্ছদ পরিকল্পনায় প্রচ্ছদশিল্পী শক্তি নোমান চারটি পাখিকে গাছের ডালে সবুজ ব্যাকগ্রাউন্ডে তুলে ধরেছেন। এরকম আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ খুব একটা দেখা যায় না। বাংলাদেশের ৫০৬ প্রজাতির পাখির বর্ণনা ও ইলাস্ট্রেশন সমৃদ্ধ বই প্রকাশ করে প্রকাশক মাজেদা হক বাংলাভাষী পাখিপ্রেমীদের প্রভূত উপকার করেছেন। বইটির বহুল প্রচার প্রত্যাশা করি।

************************

৫০৬ প্রজাতির পাখি চিনতে পড়ুন ‘ইনাম আল হক’ এবং ‘তারেক অণু’ রচিত “বাংলাদেশের পাখির ফিল্ড গাইড”

বাংলাদেশের পাখির ফিল্ড গাইড
ইনাম আল হক, তারেক অণু
প্রচ্ছদঃ শক্তি নোমান
প্রকাশকঃ বাংলাদেশ বার্ড ক্লাব, ঢাকা।
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ২১২
মূল্যঃ ৫০০ টাকা
ISBN: 978-984-33-9011-0

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ