এক শিশুবান্ধব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্মৃতিচারণঃ ‘কুরোইয়ানাগি তেৎসুকো’ রচিত “জানালার ধারে তত্তচান”

‘কুরোইয়ানাগি তেৎসুকো’ রচিত “জানালার ধারে তত্তচান”

প্রাচীন মানুষের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান তরুণ প্রজন্মের হাতে এসে পৌঁছায় ভাষার হাত ধরে। ভাষার মাধ্যমে বাহিত এই বিমূর্ত জ্ঞান যে পদ্ধতিতে নতুন মানুষের সামনে মূর্ত হয়, তার নাম শিক্ষা। শিক্ষা কী বা তার সংজ্ঞা কী এ নিয়ে শিক্ষাপ্রেমী মানুষদের মধ্যে মতভেদ আছে। দেশ কাল পাত্রভেদে এর রূপ বিভিন্ন রকম। আবার কেন শিক্ষা দেয়া হবে বা শিক্ষার উদ্দেশ্য কী তা নিয়েও দেশভেদে চিন্তাশীল মানুষদের ভাবনা বিচিত্ররকম। কেউ মনে করেন শিক্ষার্থীদের জন্ম হয়েছে বড়দের আদেশ নির্দেশ পালনের জন্য, শিক্ষকের প্রতি থাকবে তাদের নিরঙ্কুশ বাধ্যবাধকতা; যেন তারা ক্রীতদাস। আবার কেউ কেউ মনে করেন মানুষ কারও দাস হবার জন্য জন্মায় নি। শিক্ষার্থীরা স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে প্রত্যেকে আলাদাভাবে সম্মান পাবার যোগ্য। শিক্ষা কীভাবে বা কতটুকু দেয়া হবে সেই বিষয়েও রয়েছে মতভেদ। কোন কোন দেশের পণ্ডিতেরা মনে করেন পশুর মত ধরে বেঁধে পিটিয়ে শিক্ষার্থীকে শেখাতে হবে। আবার কেউ মনে করেন শিক্ষার্থী যেহেতু একজন স্বাধীন সত্ত্বা, সেহেতু শিক্ষা গ্রহণ পদ্ধতির উপর তার সম্পূর্ণ অধিকার থাকা উচিত। কেউ মনে করেন নির্দিষ্ট একটি বা কয়েকটি বিষয় ও বই পাঠ যথেষ্ট, আবার কেউ মনে করেন বিষয় বা বই নির্বাচনে একদেশদর্শী কূপমণ্ডুকতা গ্রহণযোগ্য নয়। বিশ্বের এক অংশের মানুষের চিন্তার সাথে অন্য অংশের মানুষের চিন্তা ও তার প্রকাশ পদ্ধতির পার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। সেজন্য স্থান ভেদে মানুষের সাংস্কৃতিক বিকাশের মাত্রা ভিন্নরকম। কোথাও হিংসাবিদ্বেষ প্রবণ মানুষের সংখ্যা বেশি, কোথাও বা মননশীল মানুষেরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরকম চিত্রের প্রেক্ষিতে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, কোন শিক্ষাপদ্ধতি সঠিক অথবা সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশে কোন জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা বা শিক্ষাদর্শন অধিক ফলপ্রসু?

শিক্ষার্থীদের জন্ম হয়েছে বড়দের আদেশ নির্দেশ পালনের জন্য, যেন তারা ক্রীতদাস।
শিক্ষা নিয়ে এরকম পরস্পরবিরোধী আদর্শ বা ন্যায়বোধের বিপরীতে কিছু কিছু শিক্ষাবিদ পাওয়া যায়, যাদের তৎপরতা একেবারেই মৌলিক ও ভিন্নরকম। এরকম একজন শিক্ষাবিদ 'কোবাইয়াশি সোসাকু'। তিনি জাপানের রাজধানী টোকিওতে ১৯৩৭ সালে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। 'তোমোএ' নামের এই স্কুলটি ছিল প্রাথমিক স্তরের। অন্যান্য প্রাথমিক স্কুলের সাথে এই স্কুলের আদর্শগত পার্থক্য ছিল। বলা যায়, প্রচলিত স্কুলসমূহের যে লক্ষ্য ও পদ্ধতি ছিল, তার একেবারে বিপরীতে ছিল 'তোমোএ' স্কুলের অবস্থান। এই স্কুলটির শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপদ্ধতির মনোজ্ঞ বিবরণ নিয়ে আজকের আলোচ্য বই “জানালার ধারে তত্তচান”। স্মৃতিচারণমূলক এই আত্মকথাটি লিখেছেন স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ‘কুরোইয়ানাগি তেৎসুকো’। বইটি শিক্ষাতাত্ত্বিক নয়, লেখকের স্মৃতিচারণমূলক। তবুও বইটি জাপানী ভাষায় তুমুল জনপ্রিয় হয়েছে কারণ মানুষ আধুনিক প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষাব্যবস্থায় বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। তত্ত্বচান শব্দটিকে কেউ কেউ অবশ্য 'তত্ত্বোচান' বা 'তোত্ত্বোচান' উচ্চারণ করতে চান। তবে সেটা আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়।

তেৎসুকো ছিলেন স্বাধীনচেতা কৌতুহলী মেয়ে। প্রচলিত প্রতিষ্ঠিত নিয়ম কানুনের বেড়াজালে তিনি বন্দী থাকতে চান নি। অবচেতনভাবেই শৈশব থেকে তিনি নিজের ইচ্ছেমতো পরিপার্শ্বের বিষয়গুলোকে বুঝতে চাইতেন, কোনরকম বাধ্যবাধকতার ধার ধারতেন না। যা করতে ভাল লাগত, তার বারবার করতেন; যা বলতে ইচ্ছে করত, তা নির্দ্ধিধায় প্রকাশ করতেন। আসলে এসব আচরণ একজন সাধারণ শিশুর স্বাভাবিক গুণাবলী। কিন্তু একজন কৌতুহলী শিশুর সাবলীল আচরণ প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান মানবে কেন? প্রতিষ্ঠানের কাজ যেখানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, সেখানে স্বাধীনচেতা তেৎসুকো একটা সমস্যা বৈকী। অতএব তাকে প্রথম শ্রেণীতে ভর্তির প্রথম মাসেই স্কুল থেকে বহিস্কৃত হতে হয়। তার মা সহৃদয় মানসিকতার মানুষ ছিলেন। মেয়ের এমন অপমান মেনে নেন নি। প্রতিষ্ঠানের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মেয়ের আচরণকেও খণ্ডিত খর্ব করতে চান নি। তাই তেৎসুকোকে তার অপমানের কথা জানান নি। শুধু নীরবে খুঁজে বের করেছেন অন্য এক রকমের একটি স্কুল। সেটাই হল দরদী শিক্ষক ‘কোবাইয়াশি সোসাকু’ প্রতিষ্ঠিত ‘তোমোএ’ নামের স্কুল।

এই স্কুলে লেখকের জীবনের বেশ কয়েক বৎসর কেটেছে। সেই অভিজ্ঞতা ছিল সুখময়, সক্রিয়, সৃষ্টিশীল ও আনন্দমুখর। প্রধান শিক্ষক যে সব উপায়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন বৈচিত্র্যময় করে তুলেছেন, প্রতিদিন যে সব কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা নিজেকে ও নিজের চারপাশের জগৎকে চিনে নিয়েছিল, তার আবেগমাখানো বিবরণ রয়েছে বইয়ের পাতায় পাতায়। স্কুলের শ্রেণীকক্ষগুলো তৈরি করা হয়েছিল ট্রেনের কামরা দিয়ে, কোনরকম ধারাবাহিকতা ছাড়াই সারাদিনে যার যেটা খুশি সিলেবাসের সেই বিষয় পাঠ, পড়া ভাল হলে বাইরে পদব্রজে ভ্রমণ, অন্যরকম খেলাধুলা, টিফিনে পাহাড় ও সাগরের খাবার গ্রহণ, তালে তালে গান শেখা, দেবী বেনতেনের মন্দির প্রাঙ্গনের মেলায় ভ্রমণ- এরকম মজার মজার অভিজ্ঞতা তেৎসুকো এই স্কুল থেকে পেয়েছেন।

স্কুলে প্রথম প্রবেশের দিন থেকে তিনি পেয়েছেন শিক্ষার্থী হিসেবে, মানুষ হিসেবে যথাযথ সম্মান। পুরনো স্কুলটিতে তিনি ছিলেন খারাপ মেয়ে; কিন্তু এই নতুন স্কুলে তার খারাপত্বটাই বিবেচিত হয়েছে ভালত্ব বলে। এটা হয়েছে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ, বিভিন্ন ঘটনা, বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন ভঙ্গির প্রভাবে। লেখক এসবই বর্ণনা করেছেন বইয়ের পাতায় পাতায়। লেখকের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা থেকে প্রধান শিক্ষক কেমন মানুষ ছিলেন তা বোঝা যায়। -

তত্তচানের মনে হলো এই মানুষটার মত চমৎকার একজন মানুষের সঙ্গে আগে কখনো ওর দেখা হয়নি।  আসলে, এর আগে কেউ তো কখনো ওর কথা এত মন দিয়ে শোনেই নি। এতক্ষণ ধরে, একবারও হাই না তুলে, বিরক্তি বা ক্লান্তি প্রকাশ না করে একটানা ওর কথা শুনে গেছেন প্রধান শিক্ষক, দেখে মনে হচ্ছিলো কথাগুলোতে উনিও যেন ওর মত মজা পাচ্ছেন। পৃষ্ঠা - ০৯


বইয়ের সূচিপত্র পাঠ করলেও ‘তোমোএ’ স্কুল নিয়ে লেখকের অভিজ্ঞতা ও অনুভবের মাত্রা বোঝা যায়। যেভাবে বইয়ে ছাপানো হয়েছে পৃষ্ঠাঙ্ক বাদ দিয়ে সেভাবেই সম্পূর্ণ সূচিপত্র প্রকাশ করা হল।


  • স্টেশনে প্রথম বার
  • জানালার ধারে তত্তচান
  • নতুন স্কুল
  • স্কুলটিকে ভালোলাগে
  • প্রধান শিক্ষক
  • টিফিন
  • আজ থেকে স্কুলে যাই
  • ট্রেন ক্লাসঘর
  • পাঠ
  • সাগর থেকে, পাহাড় থেকে
  • ভালো করে চিবাও
  • হাঁটাহাঁটি
  • বিদ্যালয় সংগীত
  • আগের জায়গায় রাখো
  • নামের কথা
  • হাস্যকৌতুকের গল্প
  • ট্রেন আসবে
  • সাঁতার দিঘি
  • রিপোর্ট কার্ড
  • গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়েছে
  • দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা
  • সাহস পরীক্ষা
  • রিহার্সাল হল
  • গরম পানির কুন্ড
  • ইউরিদ্‌মিক্স বা তাললয় বিদ্যা
  • জীবনের সেরা সাধ!
  • সবচেয়ে খারাপ পোশাক
  • তাকাহাশি
  • ঝাঁপিয়ে পড়ো না
  • তারপর…...
  • আমরা তো শুধু খেলছিলাম!
  • বার্ষিক ক্রীড়ানুষ্ঠান
  • কোবাইয়াশি ইস্‌সা
  • বড়োই অদ্ভুত
  • হাত দিয়ে কথা বলা
  • সেঙ্গাকুজি মন্দির
  • মাসাওচান
  • বেণী বাঁধা মেয়ে
  • থ্যাংক ইউ
  • লাইব্রেরি
  • লেজ
  • দ্বিতীয় বসন্ত
  • রাজহাঁসের হ্রদ
  • ক্ষেতের শিক্ষক
  • মাঠের রান্না
  • আসলেই তুমি ভালো মেয়ে
  • বউ
  • ভাঙাচোরা স্কুল
  • চুলের ফিতে
  • আহতদের দেখতে যাওয়া
  • স্বাস্থ্যের ছালবাকল
  • ইংরেজী বলা ছাত্র
  • বিচিত্রানুষ্ঠান
  • চক
  • ইয়াসুআকিচান মারা গেল
  • গুপ্তচর
  • বেহালা
  • প্রতিজ্ঞা
  • রকি হারিয়ে গেল
  • টি পার্টি
  • সাইয়োনারা
  • সাইয়োনারা-বিদায় বিদায়
  • পুনশ্চ


তাঁর এই পদ্ধতি কতটা সঠিক, তা বোঝার জন্য গবেষক হতে হয় না।
প্রধান শিক্ষক দেশ বিদেশের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংস্পর্শে এসেছিলেন। ১৯৩৭ সালের আগেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষার বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণাও হচ্ছিল। পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণলব্ধ অভিজ্ঞতা নিয়ে নানারকম শিক্ষাতত্ত্ব দেশ বিদেশের শিক্ষাবিদ ও শিক্ষা মনোবিজ্ঞানীরা প্রকাশ করেছিলেন। কেউ কেউ নিজের প্রাপ্ত তত্ত্ব দিয়ে নতুন ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরিও করেছিলেন। প্রধান শিক্ষক কোবাইয়াশু সোসাকু এসব জানতেন। বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া তত্ত্বের সাথে নিজের মানবিক বোধ ও কাণ্ডজ্ঞান মিলিয়ে তিনি এক নতুন ধরনের শিক্ষাপদ্ধতি ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনার কথা ভেবেছেন। যার বহির্প্রকাশ ঘটেছে নিজের প্রতিষ্ঠিত স্কুলটিতে। এখানে শিশুদের সাথে এমন আচরণের প্রস্তাব ও চর্চা করেছিলেন যেন সে মানসিক, শারীরিক এবং সামাজিকভাবে কোনরকম হীনমন্যতার শিকার না হয়ে নিজের ইচ্ছামত মুক্তভাবে বেড়ে ওঠে। তাঁর এই পদ্ধতি কতটা সঠিক, অন্যদের বিদ্বেষপ্রবণ উস্কানিমূলক শিক্ষাপদ্ধতির তুলনায় এর গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু তা বোঝার জন্য গবেষক হতে হয় না। লেখক নিজের জীবনের সাফল্য দিয়ে এই স্কুলের শিক্ষাপদ্ধতির উপযোগিতা বুঝিয়ে দিয়েছেন। বইয়ের শেষের ‘পুনশ্চ’ অংশে লেখক সে কথা বারবার বলেছেন। এক পর্যায়ে বলেন-

এই বইতে আমি কোবাইয়াশি স্যারের শিক্ষা দেয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে লিখেছি। তাঁর বিশ্বাস ছিলো জন্মের সময় প্রত্যেক শিশুর স্বভাব ভালো থাকে, বড় হতে হতে চারদিকের পরিবেশ ও বয়স্কদের প্রভাবে তা নষ্ট হয়ে যায়। তাই তিনি চেয়েছিলেন প্রতিটি শিশুর ‘ভাল স্বভাব’ খুঁজে বের করে তার বিকাশ ঘটিয়ে তাদের ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষে পরিণত করতে। পৃষ্ঠা - ১০৯

উল্লেখ্য যে, এই ধরণের একটি মুক্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনায় জাপান সরকারের কোন ভূমিকা ছিল না। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্কুলটি চালানো হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মিত্রশক্তির বোমার আঘাতে ১৯৪৫ সালে স্কুলটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। প্রধান শিক্ষক পরবর্তীতে সে জায়গায় নতুন একটি কিন্ডারগার্টেন চালু করলেও নিজে খুব বেশিদিন বাঁচেন নি। ১৯৬৩ সালে তিনি লোকান্তরিত হন। তার শিক্ষাদর্শন জাপান সরকারের যুদ্ধপরবর্তী শিক্ষাকাঠামোয় কীরকম প্রভাব ফেলেছিল তা অবশ্য জানা যায় নি। ১৯৫২-৫৪ সালের মধ্যে প্রাগমাটিক শিক্ষা দর্শন জাপানের শিক্ষাব্যবস্থায় গ্রহণ করা হয়। কিন্তু পুরনো ধরনের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয় নি। ফলে জাপান তার প্রাচীন ঐতিহ্য'র সম্পূর্ণটুকু নিয়ে বিনয় নম্রতা সহৃদয়তা অর্জনের  পাশাপাশি আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞানের ধারাতেও যথেষ্ট ভূমিকা রেখে চলেছে। ভারতবর্ষেও এরকম হতে পারত। কিন্তু আমাদের নিজস্ব শিক্ষাদর্শন হাজার বৎসর আগেই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা তো দূরের কথা গত হাজার বৎসরের প্রতিটি শতকে স্থানীয় মননশীল পণ্ডিত ঋষিগণকে অপমান, নির্যাতন ও হত্যার শিকার হতে হয়েছে। যে ভারতবর্ষে ২০টিরও অধিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, সেই ভারতবর্ষ আজ পরিণত হয়েছে অশিক্ষা কুশিক্ষার আকরভূমিতে। তথাকথিত শক্তিমান শাসকরা নিজেদের শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয় তো দূরের কথা মুক্ত জ্ঞানচর্চার জন্য একটিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন নি। বলা চলে বৃটিশরা আসার আগে যে শিক্ষাব্যবস্থা ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল, তা হাজার বৎসর আগের সমৃদ্ধ শিক্ষাদর্শনের ধ্বংসপ্রাপ্ত অস্থিচর্মসার কংকাল মাত্র। শিক্ষা নিয়ে যে সুকৃতি বর্তমান পৃথিবীর মানুষ দেখছে, তা ভারতবর্ষে হাজার বৎসর আগেই বিকশিত হয়েছিল। বিদেশী বিভাষী শাসকদের অসংস্কৃত বিদ্বেষের দাবানলে যা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। জাপানের সৌভাগ্য যে তার প্রাচীন সংস্কৃতি কোন অশিক্ষিত অমার্জিত অসংস্কৃত শাসকের বিদ্বেষ রোষানলে পড়ে নি।

বাংলা অনুবাদক হিরোকো কাসুইয়া তার ‘অনুবাদকের কথা’ অংশে বইটি সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। -

জানালার ধারে তত্তচান” কোনো জটিল ও অসামান্য চিন্তাভাবনার পরিপূর্ণ বই নয়, এটি একটি ছোট মেয়ের স্কুল জীবনের কাহিনী। ওই মেয়ে মেধাবী ছিল না। সে ছিলো একটু অস্বাভাবিক, যে খুব বেশি কথা বলতে ভালোবাসতো, সবার সঙ্গে মেলামেশা করতে পারতো না, কিন্তু যাকে ভালো লাগতো, তার জন্য সব কিছু উজাড় করে দিতে পারতো। ক্লাসে সে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতো, ডাকতো রাস্তা দিয়ে যাওয়া বিজ্ঞাপন-বাদকদের এবং এর জন্য ক্লাশের শিক্ষিকার বকা খেতো আর শাস্তি হিসেবে প্রায়ই বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে হতো তাকে।… তত্তচান যেমন অদ্ভুত ও অসাধারণ, ওই স্কুলও তেমন, অদ্ভুত ও অসাধারণ। এই স্কুলে সাধারণ স্কুল ঘর ছিল না। ছিলো ছয়টি ট্রেনের বগী, যেখানে ক্লাস বসতো।…. পড়াশোনা যে কতটা আনন্দদায়ক হতে পারে তা তত্তচান এসব ট্রেনের বগীর ক্লাসের মধ্যে খুঁজে পায়।… এ যুগটা প্রতিযোগিতামূলক, ইঁদুর দৌড়ের যুগ। কোবাইয়াশি স্যার তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের এ প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে নিয়ে বিকশিত করতে চেয়েছিলেন প্রকৃত মানুষ হিসেবে। তাঁর বিশ্বাস ছিল প্রতিটি শিশুই কোনো না কোনো সদগুণ নিয়ে জন্ম নেয়, সযত্ন লালন-পালন পেলে বিকশিত হতে পারে। তবে ওই পথের বাধা হচ্ছে পরিবেশ ও বয়স্কদের প্রভাব। কোবাইয়াশি স্যার তাঁর ছাত্রদের ওই প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে নিজ নিজ সদগুণ অনুসারে বিকশিত করতে চেয়েছিলেন।


আলোচ্য বইটি প্রথম প্রকাশ করে বাংলা একাডেমী। কত সালে সে তথ্য ডাকঘর প্রকাশনী কোথাও উল্লেখ করে নি। বাংলা ভাষায় অনুবাদটি প্রকাশকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন আজাদ এই বইয়ের ভাষারীতি সম্পর্কে মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছিলেন। কথাশিল্পী বিপ্রদাশ বড়ুয়া কিছু অংশ সংশোধন ও পরিমার্জন করেছিলেন।

বাংলা একাডেমী প্রকাশিত বইটি বাজারে পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু শিশুশিক্ষা বিষয়ে এমন একটি মজার বই পাঠকের হাতে হাতে থাকা দরকার। তাই পুনরায় প্রকাশ করে ডাকঘর প্রকাশনী বেশ ভাল কাজ করেছে। এরকম মৌলিক শিক্ষাদর্শনের চিত্র নিয়ে বাংলা ভাষায় বইয়ের সংখ্যা খুব কম। বলা চলে শিক্ষা নিয়ে চিন্তাসামর্থ বাংলাদেশী বাঙালিদের মধ্যে নেই বললেই চলে। এক শিক্ষাবার্তা পত্রিকা ছাড়া কোন প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম চোখেও পড়ে না। এরকম অন্ধকার সমকালে ডাকঘর প্রকাশনীর কর্তৃপক্ষ যে প্রদীপ জ্বালাবার চেষ্টা করছে, বিশ্বের বৈচিত্র্যময় প্রগতিশীল শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র মানুষকে জানানোর জন্য যে পরিশ্রম করছে তা প্রশংসনীয়। শিক্ষা বিষয়ে তারা বিশ্বের আরও কোন প্রচারবিমুখ শিক্ষাবিদের কার্যক্রম বা বিজ্ঞাপনের আড়ালে থেকে যাওয়া শিক্ষাদর্শনের বা শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বই প্রকাশ করুক এই প্রত্যাশা করি। বাংলাদেশের প্রত্যেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের “জানালার ধারে তত্তচান” বইটি একবারের জন্য হলেও পড়া উচিত। তাহলে তারা অন্তত নিজেদের বর্তমান মানসিকতা ও ভবিষ্যতের সমাজ গঠনে তার নিজের ভূমিকা কী হবে তা বুঝতে পারবে।

__________o0o__________

জানালার ধারে তত্তচান
কুরোইয়ানাগি তেৎসুকো
অনুবাদঃ হিরোকো কাসুইয়া

প্রকাশকঃ ডাকঘর, রংপুর।
ডাকঘর প্রকাশকালঃ ২০১২
প্রচ্ছদঃ মূল জাপানি বইয়ের প্রচ্ছদ অবলম্বনে
চিত্রাঙ্কনঃ ইওয়াসাকি চিহিরো এর চিত্র অবলম্বনে
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ১২১
মূল্যঃ ১২০/-

মতামত:_

2 মন্তব্যসমূহ

  1. সাধন দত্ত৩০/৪/২০, ১১:২২ AM

    শিক্ষা বিষয়ক বই নিয়ে আর তো কেউ আলোচনা করে না। তাই আপনাদের এখানে প্রসঙ্গটি দেখে ভাল লাগল। হ্যাঁ, এই স্কুলটি একটি নতুন মতাদর্শ নতুন জীবনবোধ জাপানী সমাজে উপস্থাপন করতে পারতো। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ২য় বিশ্বযুদ্ধ সব শেষ করে দিয়েছে। এখন অবশ্য নতুন করে এই স্কুলের কথা সবাই জেনে যাওয়ায় জাপানীরা নিজেদের সংস্কৃতি নিজেদের দর্শন নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে, এবং সমাজে নিজেদের দর্শন, নীতিবোধ, জীবনচেতনা প্রয়োগের কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। আপনি ভারতীয় শিক্ষাবিজ্ঞান নিয়ে যা বলেছেন, সেটাও গ্রহণযোগ্য। আমাদের দেশীয় শিক্ষাবোধ ছিল উন্নত, যখন সারা পৃথিবী অশিক্ষা কুশিক্ষায় নিমজ্জিত ছিল, তখন আমাদের দেশে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়। আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষকে শিক্ষা দিতাম। মানবিক বোধ বিনির্মাণ, নতুন আবিষ্কার, বিদ্যা শিক্ষার উৎসাহ আমরা সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলাম। আর এখন আমরা পরিণত হয়েছি মুর্খ জাতিতে। কি দুর্ভাগ্য। বিদেশী আরবীয় সাম্রাজ্যবাদ আমাদের মৌলিক চিন্তাভাবনার জায়গাটাকেই নষ্ট করে দিয়েছে। আচ্ছা, এখানে পড়লাম যে দেবী বেনতেনের মন্দিরে ওরা গিয়েছিল। এই দেবী বেনতেন হচ্ছেন ভারতীয় বিদ্যার দেবী সরস্বতী। জাপানী ভাষায় তাকে বেনতেন বলা হয়। সে কথা একটু উল্লেখ করলে পারতেন। যা হোক, সুন্দর আলোচনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই।

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. শিক্ষা নিয়ে সুচিন্তিত মতামত দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। দেবী বেনতেন সম্পর্কে তথ্যটি জানা ছিল না। ধন্যবাদ

      মুছুন

মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম