উপন্যাস চিনতে পড়া উচিত ‘রণেশ দাশগুপ্ত’ রচিত “উপন্যাসের শিল্পরূপ”

উপন্যাস চিনতে পড়া উচিত ‘রণেশ দাশগুপ্ত’ রচিত “উপন্যাসের শিল্পরূপ”

বাংলাদেশের সুখ্যাত সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর উদ্যোক্তাদের একজন রণেশ দাশগুপ্ত। সাহিত্যচর্চাকে নিয়েছিলেন চিন্তাচর্চার মাধ্যম হিসেবে। প্রবন্ধ জাতীয় রচনার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ কৃতিত্বের দাবীদার। প্রগতিশীল চিন্তাধারা, আলোচ্য বিষয় বিশ্লেষণের ক্ষমতা, সাবলীল সহজ শব্দে, বাক্যে নিজেকে প্রকাশ দক্ষতা ছিল অসাধারণ। একজন চিন্তক হিসেবে তিনি সাহিত্যের উদ্দেশ্য নিয়ে ভাবতেন। কেন উপন্যাস রচনা করা দরকার, উপন্যাসের প্রয়োজনীয়তা কী, উপন্যাস কাকে বলে বা এর সংজ্ঞা কি হওয়া উচিত এরকম বিভিন্ন সাহিত্য সম্পর্কিত প্রশ্ন তাঁকে তাড়িত করত।

সাহিত্যকে বিশ্লেষণ, মূল্যায়ন পদ্ধতির বৈশিষ্ট্যসহ সৌন্দর্যের সংজ্ঞা, বিচার, বিশ্লেষণ প্রভৃতি নিয়ে তার উল্লেখযোগ্য বই "উপন্যাসের শিল্পরূপ"। এই বইয়ে রণেশ দাশগুপ্ত তাঁর উপন্যাস সম্পর্কে বহুপ্রকার চিন্তার সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন।

"প্রকাশকের কথা" অংশ থেকে জানা যায়-

'উপন্যাসের শিল্পরূপ' তাঁর সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ। এতে উপন্যাস সাহিত্যের শিল্পগত দিক সম্পর্কে তিনি মূল্যবান আলোচনা করেছেন। বইখানার মূল ভিত্তি ক্রিস্টফার কডওয়েলের 'মায়া ও বাস্তব' (Illusion and Reality) এবং রালফ ফক্‌স-এর 'উপন্যাস এবং জনসাধারণ' (The Novel and the People)

লেখক তাঁর ‘মুখবন্ধ' অংশে এই বইয়ের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কয়েকটি কথা বলেছেন। তিনি জানান-

উপন্যাসের উদ্ভব ও গতিপরিণতিকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে উপন্যাসের মৌলিক শিল্পসত্তাকে বুঝবার চেষ্টা হয়েছে এই লেখাটিতে। বিভিন্ন প্রখ্যাত লেখকের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ থেকে অবাধভাবে উদ্ধৃতি দাখিল করা হয়েছে বিভিন্ন প্রশ্নকে সহজভাবে উপস্থিত করার জন্য।

মুখবন্ধে লেখক রণেশ দাশগুপ্ত আরও বলেন-

যেহেতু সমগ্র কথাশিল্পের মধ্যে উপন্যাসই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি প্রমুক্ত, সেজন্য কোনরকম বাঁধা গৎ দিয়ে উপস্থিত বইটিতে সুর তুলতে চেষ্টা করা হয়নি, অন্তত এ আশ্বাস পাঠক-পাঠিকাদের দিতে পারি। 'উপন্যাসের শিল্পরূপ' নিজস্ব কোন অভিমত প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছে কিনা, সে বিচার পাঠক-পাঠিকারা করবেন।

অর্থাৎ লেখক এই বইতে উপন্যাস সম্পর্কে স্বতন্ত্র্য কোন একটি মতবাদ বা মতামত প্রকাশ করতে চেয়েছেন।

প্রকাশকের কথা থেকে জানি যে এই বইয়ের মূল ভিত্তি হল ক্রিস্টফার কডওয়েলের 'মায়া ও বাস্তব' এবং রালফ ফক্‌স এর 'উপন্যাস এবং জনসাধারণ' বই দুটি। 'ভিত্তি' বলতে কি বোঝানো হচ্ছে তা স্পষ্ট নয়। তিনি কি উপর্যুক্ত বইদুটির অনুবাদ করেছেন? নাকী সেগুলোকে তার মতামতের মূল আদর্শ ধরে নিয়ে তার বিস্তৃতসাধন করেছেন? এ ধারণা করার কারণ লেখক তার মুখবন্ধে উল্লেখ করেছেন। তিনি সেখানে বলেছেন-

ঢাকা থেকে প্রকাশিত দ্বিমাসিক সাহিত্যপত্র 'উত্তরণ' এর কার্তিক-অগ্রহায়ণ, ১৩৬৫ সংখ্যায় 'উপন্যাসের শিল্পকলাগত গতিপরিণতি' নামে আমার যে প্রবন্ধটি ছাপা হয়, তার মূল বক্তব্যকে সম্প্রসারিত করেই 'উপন্যাসের শিল্পরূপ' লেখা হয়েছে।

উপন্যাস প্রসঙ্গে এই বইতে আসলেই কোন সারকথা উপস্থাপন করা হয়েছে কি না তা জানতে বইয়ের পাতায় ডুব দিতে হবে। মোট একুশটি রচনা দিয়ে এই বই সাজানো। এক পৃষ্ঠা থেকে চার পৃষ্ঠাব্যাপী রচনার সংখ্যাই সর্বাধিক। তবে বিশতম রচনাটি দশ পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ।

ক্রিস্টফার কডওয়েল তার এক নম্বর বক্তব্যে জানান-

সঙ্গীত, কবিতা এবং উপন্যাসের ধ্বনি-প্রতীকের কাজ ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। উপন্যাসের ধ্বনি-প্রতীক হচ্ছে বহির্বাস্তবে অবস্থিত বিষয়-বস্তুর প্রতীক; কবিতার ধ্বনি-প্রতীক অনুভব-তরঙ্গ ও স্মৃতিচিত্রের শব্দপদজাত জটিল মানসের প্রতীক; সঙ্গীতের ধ্বনি-প্রতীক আংশিকভাবে আপাত বহির্বাস্তবের প্রতীক।

উপন্যাস প্রসঙ্গে এই বইতে আসলেই কোন সারকথা আছে কি না তা জানতে বইয়ের পাতায় ডুব দিতে হবে। একুশটি রচনা দিয়ে এই বই সাজানো। এক পৃষ্ঠা থেকে চার পৃষ্ঠাব্যাপী রচনার সংখ্যা বেশি। তবে বিশতম রচনাটি দশ পৃষ্ঠাব্যাপী দীর্ঘ। এই বই পড়তে পড়তে পূর্বোক্ত লেখকদ্বয়ের মতাদর্শের উপস্থাপন, বিশ্লেষণ করার প্রসঙ্গে লেখকের নিজস্ব মতের ছায়া দেখি। তিনি বলেনঃ-

এ এক ধরনের স্ববিরোধিতা বই কি!
ডি. এইচ. লরেন্স ফোর্ড এবং লেনিনকে ছাঁচে ঢালা মানুষ তৈরির ব্যবস্থার কাণ্ডারী বলে অভিযুক্ত করলেও তিনি নিজে নির্গলিত অভিপ্রায়ের তিমির প্রবাহ ও আদিম সূর্য-জ্বালার বৈজয়ন্তী উড়িয়ে ব্যক্তিবাদের বিরোধিতাই করেছেন। জার্মেনির অতিজাতিয়তাবাদী নাৎসীরা ডি. এইচ. লরেন্সের উপন্যাসে গোষ্ঠীরক্তবাদের বিশ্ববীক্ষার গন্ধ পেয়েছিল। পৃষ্ঠা- ৩৪

মার্কিন মহাকাব্যপন্থী ঔপন্যাসিক রাওয়ার্ড ফাস্ট তার 'সাহস ও বাস্তবতা' গ্রন্থে সমকালীন এক ধরনের উপন্যাসকে 'বিকার' বলে উল্লেখ করেছেন। এর উদাহরণ হিসেবে আলোচনা করেছেন কাফকা লিখিত অবিস্মরণীয় উপন্যাস 'মেটামরফসিস'। রণেশ দাশগুপ্ত হাওয়ার্ড ফাস্টকে উপস্থাপন করেছেন, কারণ তার বক্তব্য উপন্যাসকে একটা ভিন্ন অবস্থান থেকে ব্যাখ্যা করে। মানবীয় বিকারগুলো উপন্যাসে যেভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তার কার্যকারণ এরকমঃ-

এর অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেকটি গল্পের মূলসূত্র হচ্ছে এক এক ব্যক্তির অন্তরাত্মার এক একটা বীভৎস তাড়না বা উদ্ভট ও উৎকট স্নায়বিক আতিশয্য। অর্থাৎ ব্যক্তির ভঙ্গুর মানবিক আবরণের নিচে রয়েছে নরপশু এবং রয়েছে সেইসব আদিম পাশবিক প্রবৃত্তিসমূহের হুঙ্কার ও আর্তনাদ যারা চরিত্র-বিনাশী। পৃষ্ঠা- ৩৭

তেরোতম অধ্যায়ে কথাপ্রসঙ্গে উপন্যাস সম্পর্কে ফিল্ডিং এর বক্তব্যও লেখক যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। যেখানে ফিল্ডিং উপন্যাসের চাইতে ঔপন্যাসিকের ভূমিকাকে বেশি নির্দিষ্ট করে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি মনে করেনঃ-

আমাদের আয়ত্তাধীন ও জ্ঞানের পরিধির মধ্যে যা কিছু আছে, তাদের সবাইকার মর্মস্থলে প্রবেশ করার এবং তাদের অন্তর্নিহিত পার্থক্য নির্ণয়ের ক্ষমতা রাখতে হবে ঔপন্যাসিককে। পৃষ্ঠা- ৩৯

ফিল্ডিং এর উপন্যাসবাদ আসলে এক নতুন বাস্তববাদ। তিনি জানেন যে আধুনিক মনস্তত্ব মানব স্বভাব সম্পর্কে বিশেষ করে মানবমনের গভীরতর ও অবচেতন উপাদানসমূহ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করেছে। তিনি মানবচরিত্র উপস্থাপনের সময় এই ব্যাখ্যা উপেক্ষা করেন না। নিজের মত প্রকাশ করেন এভাবেঃ-

ফ্রয়েড, হেভলক এলিস, কিংবা পাভলভের গবেষণাসমূহও মনস্তাত্ত্বিকের উপর নিজের দায়িত্ব চাপিয়ে দেবার জন্য ঔপন্যাসিককে বাধ্য করতে পারে না। ইডিপাসের মানসিক সংস্কার (Oedipus complex) অথবা মনসমীক্ষার অন্য যে কোন ধরনের বিকৃতির বিরাট ঘটা দেখিয়ে মনস্তাত্ত্বিকরা নিছক মনোভিত্তিক যুক্তির উপর মানুষী চিন্তার প্রক্রিয়া অথবা মানবাত্মার রূপান্তর ব্যাখ্যা করবেন, এ কথাটাকে মেনে নেওয়া যেতে পারে না। পৃষ্ঠা-৪০

তবে বিজ্ঞানকে মেনে নেওয়ার কোন বিকল্প নেই; ঔপন্যাসিকের একথা জানা থাকা উচিত। সে ভাবনা অকপটে মেনে নিয়ে ঘোষণা করেন -

আধুনিক মনস্তাত্ত্বিকরা যে মানুষ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান-ভাণ্ডারকে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ করেছেন, এটা নিঃসন্দেহ। যে ঔপন্যাসিক এঁদের অবদানকে উপেক্ষা করবেন, তিনি যেমন অজ্ঞ, তেমনি মূর্খ প্রমাণিত হবেন। পৃষ্ঠা- ৪১

হাওয়ার্ড ক্লিউয়িস ১৯৫০ সালে আরেক ঔপন্যাসিক স্তাঁদাল এর এক শিল্পীজীবনী লিখেন। স্তাঁদালের যে পরিচয় বর্ণনা করেন, তার রচনার যে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ দেন, তার বিবরণ প্রদান করে রনেশ দাশগুপ্ত পরিশেষে মন্তব্য করেনঃ-

শেষোক্ত মন্তব্য দ্বারা ক্লিউয়িস বোঝাতে চেয়েছেন যে, আধুনিক যে 'নারকীয় নর্দমাপন্থীরা' উপন্যাসকে তাদের ক্ষত-প্রদর্শনের জায়গা করে তুলেছেন, স্তাঁদাল তাদের স্বগোত্র।

নিজের এমন সিদ্ধান্তের পর এর বিপরীত মত হিসেবে রাল্‌ফ ফক্‌স্‌ এর মতামত জানানঃ-

রাল্‌ফ ফক্‌স্‌ তাঁর 'উপন্যাস এবং জনসাধারণ' গ্রন্থে স্তাঁদালের উপন্যাসকে উনিশ শতকের মহীয়ান উপন্যাসসমূহের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন।

এভাবে উপন্যাস সম্পর্কে তিনি বিভিন্ন মণীষীগণের মনোভাব বুঝতে চেয়েছেন। এই বইতে রাল্‌ফ ফক্‌স্‌ এবং ক্রিস্টোফার কডওয়েল এর দৃষ্টিভঙ্গিতে অন্যান্য ঔপন্যাসিকগণের বিশ্লেষণ ব্যাখ্যা নিঃসঙ্কোচে করেছেন। কখনও মনে হয় উপর্যুক্ত দুইজনের বই পাঠকালীন সময়ে চিন্তা করা প্রতিক্রিয়াগুলির প্রকাশ হচ্ছে এই 'উপন্যাসের শিল্পরূপ'। রণেশ দাশগুপ্ত উপন্যাসের সংজ্ঞা বুঝতে চেয়েছেন। আসলে উপন্যাসের সংজ্ঞায়ন একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া; এই অভিযাত্রায় তার পদচারনা বইয়ের ছত্রে ছত্রে পরিস্ফুট। এই বই পাঠ করলে উপন্যাস সম্পর্কে অন্য অনেকের মন্তব্য, প্রতিক্রিয়া জেনে নিজের একটি ধারনা তৈরি করা সম্ভব হবে। হাতের কাছে পাওয়া উপন্যাসগুলোকে চিনতে দারুণভাবে সহায়ক হবে। তার ভাষা সহজ, উপস্থাপনভঙ্গি সরল। এই বই কেন বাজারে কম পাওয়া যায়, তা জানি না। প্রশ্নপ্রবণ চিন্তাশীল পাঠক এই বই থেকে উপন্যাসের দারুণ সব অভাবিত বৈশিষ্ট্য জানতে পারবেন। চিনতে পারবেন বৈচিত্র্যময় উপন্যাসের বর্ণিল ভুবনকে।

####################

উপন্যাসের শিল্পরূপ
রণেশ দাশগুপ্ত


প্রচ্ছদঃ মোবারক হোসেন লিটন

প্রকাশকঃ খান ব্রাদার্স এন্ড কোম্পানী, ঢাকা।
প্রকাশকালঃ ২০১০

পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ৮০
মূল্যঃ ১০০.০০ টাকা মাত্র
ISBN: 984-408-164-5

মতামত:_

1 মন্তব্যসমূহ

  1. শঙ্কর রায়৬/৮/২০, ৫:১৯ PM

    ধন্যবাদ। পড়তে হবে। এই ধরনের চিন্তাপ্রদায়ী বই আরও বেশি প্রকাশ করার দাবী জানাই।

    উত্তরমুছুন

মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম