মাসুমুল আলমের উপন্যাস ‘রঁদেভু’ সম্পর্কে পাঠকের একগুচ্ছ প্রতিক্রিয়া

মাসুমুল আলমের উপন্যাস ‘রঁদেভু’


সৃজনশীল লেখকগণের রচিত গ্রন্থ সম্পর্কে নিবিষ্ট পাঠকদের মতামত প্রকাশের একটি নতুন ধারা গ্রন্থগত ওয়েবসাইটে শুরু করা হল। আজ প্রকাশ করা হল সমকালীন কথাসাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র মাসুমুল আলমের সম্প্রতি প্রকাশিত উপন্যাস ‘রঁদেভু’ সম্পর্কে কয়েকজন মননশীল পাঠকের একগুচ্ছ পাঠপ্রতিক্রিয়া।

দুইজন নারী-পুরুষের জীবনের নানাবিধ ঘটনার পরম্পরা এই উপন্যাসের মূল বিষয়। দুজন নারীপুরুষ সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের নৈকট্যে আসে। টেক্সট মাধ্যমে মনোবিনিময় তথা চ্যাটিংয়ের ধারাবাহিক সংলাপের মাধ্যমে নিজেদের অন্তর্জগতকে উন্মোচন করে। সম্পর্ক বিনির্মাণের গতিপথ ভরে ওঠে বিষন্নতা আর ক্ষুব্ধতায়। যা পর্যবসিত হয় অপ্রত্যাশিত ব্যর্থতায়।


রঁদেভু’ উপন্যাস প্রসঙ্গে মাসুমুল আলম বলেন-

আপাতদৃষ্টিতে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে দু’জন নারী-পুরুষের কথালাপের চাপান-উতোরে কে কাকে ডিসকম্ফোর্ট জোনে ইয়ে করতে পারল, অথবা উচ্চমন্য বা হীনমন্য করতে পারল তা যতটা না, যতটা না জানা-বোঝা রেফারেন্সের ভার, তারচে’ বরং দু’জনের নিভৃত কথামালায় আসঙ্গলিপ্সার পাশাপাশি সময়ের অনেক প্রাণবন্ত আড্ডার বহু পুংকণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠস্বরে কিংবা বহু কণ্ঠস্বর একটি নারী স্বরে প্রতিধ্বনিত হয়েছে।


গল্পের মনোজ্ঞ উপস্থাপনের জন্য মাসুমুল আলম অল্প সময়ের মধ্যে পাঠকপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। এ পর্যন্ত তাঁর চারটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। অন্যগুলো হল- ‘র‌্যাম্প, বার-বি-কিউ আর কানাগলির হুলো’, ‘আরব্য রজনীর ঘোড়া’ এবং ‘মৌনধারাপাত’। এছাড়াও ছোটগল্প রচনায় তিনি সিদ্ধহস্ত। ‘নামপুরুষ ও অন্যান্য’, ‘দর্শনীর বিনিময়ে’ ও ‘বরফের ছুরি’ গল্পগ্রস্থগুলো ইতোমধ্যে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অনুবাদ করেছেন ফিলিস্তিনি সাহিত্যিক ঘাসান কানাফানি লিখিত উপন্যাস ‘মেন ইন দ্য সান’। লিখেছেন মুক্ত গদ্যের বই ‘কথাপরিধিঃ ২২ পয়েন্ট বোল্ড ও অন্যান্য’। রঁদেভু প্রকাশ করেছে প্রকাশনা সংস্থা ‘উড়কি’, আর অনবদ্য প্রচ্ছদটি অংকন করেছেন শিল্পী মোস্তাফিজ কারিগর। হার্ড কভারে বাঁধাই করা উপন্যাসটির পৃষ্ঠাসংখ্যা ১৯৬।


তাঁর রঁদেভু উপন্যাস সম্পর্কে কয়েকজন বিদগ্ধ পাঠকের মতামত প্রকাশ করা হল। পাঠকের মনোলোকে উপন্যাসটি যে গভীর অনুভূতির সৃষ্টি করেছে, উপন্যাসের চরিত্রগুলো যে সমকালীন দৃশ্যপট তৈরি করেছে সেই অভিজ্ঞতা তাঁদের বক্তব্যের প্রধান বিষয়। প্রতিশ্রুতিশীল লেখকগণের রচনা সম্পর্কে মনোযোগী পাঠকদের ভাবনা প্রকাশের এই ধারা চলমান থাকবে।
---- উদ্যোক্তা, গ্রন্থগত

_______ ০ _______

।। এক ।।

এই উপন্যাসে মাত্র দুইটি চরিত্র, শুক আর সারি; অনবরত কথা বলে চলছে, মেসেঞ্জারে। কথার সম্পর্ক। ভার্চুয়াল সেল্ফ-এর গল্প হলো এই রঁদেভূ উপন্যাস।

যে জীবনের গল্প, এলোমেলো যেন, ব্যক্তির নিজের নির্মিত এক যাপন, অন্যরকম, ঘটনা দূর্ঘটনা ঘটাতে থাকে। বিষন্নতা আছে কিন্তু কান্না নাই।

সম্পর্ক, রাজনীতি, সমাজ সবমিলিয়ে ভার্চুয়াল এক রিয়েলিটিতে আমরা, এটাই দেখাচ্ছে মনে হয় উপন্যাসটা।

দু'জনের কথোপকথনে কখনো রাজনৈতিক ঘটনাবলীও ঢুকে পড়ে, হারিয়েও যায়, একের পর এক। তথ্য, প্রতি-তথ্য, খবর, বানানো খবর, গুজব সবমিলিয়ে 'ওয়ান ডাইমেনশনাল' প্রতিক্রিয়া লোকজনের; নির্ধারণ করা এদিকে না হলে ওদিকে। প্রতিক্রিয়া আছে কিন্তু সংযোগ নাই।

সাগর নীল খান দ্বীপসাহিত্য বিষয়ক কথাবার্তায় ঠাসা এই উপন্যাস, যেহেতু চরিত্র দুজনই লেখক। শিল্পের নানা সম্ভাবনা নিয়ে যেমন ডিসকোর্স উঠে এসেছে, তেমনই সাহিত্যিক গোষ্ঠী বলতে যে একটা ক্লাব আর পিকনিক কালচার, এইসব কানেক্টেড লেখক সামাজিকতার বিবরণও পাওয়া যায় এখানে।

সংলাপ-প্রধান এই উপন্যাসে সংলাপের সমান্তরালে শুক-সারির স্বগত কথার অংশগুলো আলাদা আলাদা গল্প হয়ে উঠেছে, স্পেস তৈরি করেছে। যাবতীয় দেখা-শোনা-বুঝের পাঞ্চ হলো এই উপন্যাস, আর যৌনতাড়িত এক মনোজগতকে দেখতে পাই। সময়টাকে ধরতে লেখার অন্য এক কাঠামো তৈরি করে নিতে হয়েছে মাসুমুল আলমকে।

বইটা প্রকাশ করেছে উড়কি।
____________________
# সাগর নীল খান দ্বীপ, প্রাবন্ধিক ও প্রকাশক, উলুখড়


।। দুই ।।

তানজিন তামান্নামাঝেমধ্যে এরকম হয় যে, কোনো বই, কোনো একটি কবিতা এই মুহূর্তে পড়তে না পারলে মরেই যাবো! সঙ্গীত আর সিনেমার জন্যও এমন অনুভূতি হয়! রিসেন্ট একটানা পড়ে শেষ করলাম মাসুমুল আলমের নতুন উপন্যাস 'রঁদেভু' ❤️ উপন্যাসটা পড়া শুরু করার পর এরকম হতো-- রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় ভাবতাম সকালে তাড়াতাড়ি উঠে কখন আবার উপন্যাসের বাকীটা পড়া শুরু করবো-- 'রঁদেভু' এমনই একটি উপন্যাস। মনে হচ্ছে এই উপন্যাসের জন্যও পরবর্তীতে 'পড়তে না পারলে মরেই যাবো' এরকম অনুভূতি হবে...
____________________
# তানজিন তামান্না, কবি ও সম্পাদক, ওয়াকিং ডিসট্যান্স


।। তিন ।।

মাসুমুল আলমের নতুন উপন্যাস 'রঁদেভু' পড়লাম। দুই চরিত্র শুক ও সারির অনলাইন চ্যাট ও স্বগতোক্তির মাধ্যমে উপন্যাস এগিয়ে যেতে থাকে। প্লট নির্মাণ, চরিত্র বিশ্লেষণ, কাহিনী পরম্পরা-উপন্যাসের এসব প্রচলিত রীতি এখানে নেই। শুক ও সারির কথোপকথনে ওঠে আসে সময়ের যন্ত্রণা, সাহিত্য জগতের নানান ক্লেদাক্ত দিক, যৌনতা, শারীরিক প্রেম, এ নিয়ে কয়েকজন নারী সাহিত্যিকের অভিজ্ঞতা। শামসুল কিবরিয়া হ্যাশ ট্যাগ মি টু, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের ছাত্র আন্দোলন, বাংলা সাহিত্যের কেন্দ্র বিষয়ক কথাবার্তা, এসব নিয়ে শুক ও সারির মধ্যে কথা বিনিময় হয়।

প্রসঙ্গক্রমে ওঠে আসে করোনার বিষয়টিও। বর্তমানের প্রযুক্তি-মূলত ফেসবুক ও ম্যাসেঞ্জার এ উপন্যাসে মূল ভূমিকা পালন করে। উপন্যাস পড়তে পড়তে কখনো মনে হয় একটি দৃশ্য গড়ে ওঠছে। পরমুহূর্তেই এটা আবার ভেঙে পড়ে। এ এক কঠিন মানসিক যাত্রা বটে। প্রতিষ্ঠিত ঘরানার বাইরে যারা পাঠ অভিজ্ঞতা বাড়াতে চান তাদের কাছে উপন্যাসটি নিশ্চয় আদৃত হবে।
____________________
# শামসুল কিবরিয়া, গল্পকার ও সম্পাদক, বই কথা


।। চার ।।

সাহিত্য করতে এসে অনেক কিছু হারানোর পাশাপাশি পেয়েছিও অনেক। অনেক মানুষের ঘৃণা ও ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছি এবং হচ্ছি বারবার। মাস কয়েক আগে কবি নাভিল মানদার তাঁর কবিতার বই ‘আলোকাটা লেন’-এর দ্বিতীয় সংস্করণের উৎসর্গপত্রে আমার নামটাও রেখেছেন।

উপল বড়ুয়া

তেমনি কবি চঞ্চল নাঈমও তাঁর ‘ধু ধু’ কবিতার বইটিতে উৎসর্গপত্রে যুক্ত করেছেন আমার নামখানা। এবার, সম্প্রতি উড়কি থেকে প্রকাশিত কথাসাহিত্যিক মাসুমুল আলমের চতুর্থ উপন্যাস ‘রঁদেভু’র উৎসর্গপত্রে রয়েছে এই অধমের নাম। এ তো আমার জন্য বিশাল কিছু। বিশাল ভালোবাসার। কিছুদিন আগে কবি জিললুর রহমান আমাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছেন। তাঁর ভালোবাসার কাছেও আমি আবদ্ধ। আমাদের সময়ের অন্যতম কবি হিজল জোবায়েরের একটা কবিতাতেও আমার নামখানা দেখে চমকে উঠেছিলাম। এমন ভালোবাসার কাছে নতজানু হয়ে থাকি সর্বদা। উনাদের এসব ভালোবাসা অপরিশোধ্য। মাসুমুল আলম ভাইয়ের প্রকাশিত নতুন উপন্যাসটি পড়ার তর সইছে না। উনার গদ্য-গল্প বলার ঢঙ সবসময় চিন্তার খোরাক যোগায়। এই উপন্যাসটিও আশা করি তাই হবে। সুযোগ পেয়ে সবাইকে একসঙ্গে ভালোবাসা ও ধন্যবাদ জানালাম। আপনারা আমার হৃদয়ে থাকবেন সবসময়।
____________________
# উপল বড়ুয়া, কবি, গল্পকার ও অনুবাদক


।। পাঁচ ।।

মাসুমুলকে অভিনন্দন।

ফর্ম আর টেক্সট এর নিখুঁত মেলবন্ধনের এক অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে এই উপন্যাস।

প্রায় চলচ্চিত্রের মতো দু'জন মানুষের সংলাপের(ভার্চুয়াল) ভেতর দিয়ে সময় আর স্থানিক সংকটগুলি এতো সম্পূর্ণ রূপে ধরা দিচ্ছে এই লেখায় যে এর প্রত্যেকটা সংলাপে পাঠকের পূর্ণ মনোযোগ এর অভাব ঘটলেই পাঠককে রিওয়াইন্ড করতে হবে (আমার ক্ষেত্রে তাই ঘটেছে)।

মোশারফ খোকন

শব্দে লিখিত সংলাপ পাঠের একটা মৌল সমস্যা যে আমরা সংলাপ যে বলছেন তার এক্সপ্রেশনটা দেখতে পাচ্ছি না, মাসুমুল সেই বোধ থেকেও তার পাঠককে মুক্ত করেছেন সংলাপের মাঝে মাঝে চরিত্রের মননের স্বাদু বর্ণনা দিয়ে।

আনন্দের বিষয় হলো, এসব করেও পাঠকের চিন্তা ও কল্পনার জন্য অনেক দরোজা জানালা খোলা রেখেছেন লেখক।

এতো বিচিত্র সংকট আমাদের চলমান জীবনে, মাসুমুল এই ১৯৬ পাতার ভেতর তার প্রায় সম্পূর্ণটাকেই নিয়ে এসেছেন তার বোধের গভীর বোঝাপড়া দিয়ে।

যারা আধা মনোযোগ দিয়ে গপ্প পড়তে চান তাদের এই বই এড়িয়ে যাওয়াই ভাল।

আর আপনি যদি একটা বই পড়ে আপনার চিন্তা আর বোধকে চ্যালেঞ্জ করতে চান, তবে স্বাগতম আপনাকে মাসুমুলের "রঁদেভু" পয়েন্টে।
____________________
# মোশারফ খোকন, গদ্যকার ও চিত্রশিল্পী


।। ছয় ।।

এই লেখার ফর্ম এমন-ই, যেন ফর্মটাই হলো উপন্যাস যা রঁদেভু’র বেলায় একমাত্র বাস্তব। এতোটাই বাস্তব মনে মনে সন্দেহ জাগে এটা কী উপন্যাস না অন্যকিছু চুগতাই। এবঙ অবাক ব্যাপার সন্দেহ যতো জেগে জেগে জাগ্রত হয় রঁদেভু ততোটাই সন্দেহাতীত আকর্ষণ তৈরী করে। অবশ্যই উপন্যাসটির মাল্টি টেক্সট একটা ফ্যাক্টর হয়ে উঠেছে এক নবরূপ ফর্মের পেট থেকে জন্ম নিয়ে। আমি শুধু ভাবছিলাম কতোটা দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে মাসুমুল আলম এরকম একটা ফর্ম ক্রিয়েট করতে পারে। ক্রাইসিস ফিল করার তুমুল সক্ষমতা। গোটা উপন্যাসে মোটে দু’টো ক্যারেক্টার। একজন নারী ও একজন পুরুষ। শুক আর সারি। অথচ এই দুই ক্যারেক্টারের অন্তস্থল দিয়েই ভেসে গেছে জগতের তাবৎ চরিত্রদের উঠানামা। ডকু ও ফিকশন পরস্পর কাটাকাটি করে এগিয়ে গেছে অন্যমাত্রায়।

নাভিল মানদার

শুক ও সারির অনর্গল কথালাপ এবঙ তাদের কথার তলায় দানা বেঁধে উঠেছে দুর্নিবার সম্পর্ক। যদিও শেষে গিয়ে সম্পর্কহীনতা তাদের বহন করতে হয়। তবু তাতে সম্পর্ক ফুরিয়ে যায়না। শুক ও সারির স্বগত কথনপর্ব এতোটাই অতল থেকে উঠে আসা আত্মজৈবনিক ডেলিভারি যা উপন্যাসের কেন্দ্রিয় কাঠামো রূপে উদ্ভাসিত। আর তাদের ভার্চুয়াল সংলাপ আসবাবপত্র হিসেবে দারুণ মানিয়ে গেছে কাঠামোয়। প্রেম, বিষণ্ণতা বা ক্ষুব্ধতা তাদেরকে কুৎসিত করেনি বরঞ্চ একটি দ্বন্দ্বমুখর ক্রীড়ার তীব্র উত্তেজনা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। ফুলটাইম জব। তুমি আমি আছি অথবা নেই— দিজ ইজ নট এ ফ্যাক্টর। শুধুমাত্র একটি দানবিক স্বত্তা প্রবাহিত। তবু এতো এতো কথার মাঝারেও মাসুমুল আলমের রঁদেভু এমন এক মৌন আবেগ যেখানে কালসর্প দংশনের তীব্র যন্ত্রণা আছে, আছে যন্ত্রণার অনুসন্ধান।

রঁদেভু’র বাক্য, বাক্যের গতিময় চাতুর্যে মনোজগত আবর্তন করে পাঠকের দৃষ্টি ডাগর চোখে বিস্ফারিত হয়। এই একা উপন্যাস মানে রঁদেভু কন্টকিত শাখা প্রশাখা অতিক্রম করে নতুন কন্টকের দেখা দিলো মানে কূট মানে আভাস। কথাসাহিত্যিক মাসুমুল আলম আরো চাগিয়ে দিলেন। রঁদেভু প্যারালাল আড়নয়ন।
____________________
# নাভিল মানদার, কবি


-0-0-0-0-0-0-

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ