ভূমিকা
অবিভক্ত চট্টগ্রাম জেলা প্রায় ১৬৬ মাইল দীর্ঘ। এই দীর্ঘ ভূখণ্ডের ভূপ্রকৃতি ও জনসংস্কৃতির মধ্যে কিছুটা আঞ্চলিক বিভিন্নতা পরিদৃষ্ট হয়। উদাহরণ স্বরূপ, মীর সরাই এর অধিবাসীদের কথ্যভাষার সাথে দক্ষিণ চট্টগ্রামের অধিবাসীদের কথ্যভাষার মধ্যে পার্থক্য সহজেই বোঝা যায়। সন্দ্বীপের অধিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে চট্টগ্রামের মূল ভূখণ্ডের লক্ষনীয় পার্থক্য রয়েছে।
কেবলমাত্র ভাষার দিক দিয়ে নয়, সংস্কৃতির দিক দিয়েও উত্তর, মধ্য এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের মধ্যে কিছু পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। চট্টগ্রামের মূল ভূখণ্ড হিসাবে মধ্য চট্টগ্রাম (কর্ণফুলী নদী ও শংখ নদের মধ্যবর্তী ভূভাগ) এক বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এই বিশেষত্বের দিকে লক্ষ্য রেখেই বর্তমান গ্রন্থের শিরোনাম এবং বিষয়বস্তু নির্দ্ধারণ করা হয়েছে।
মধ্য চট্টগ্রামের একটি বিশেষত্ব হলো এখানেই প্রাচীন যুগে হরিকেল নামে একটি স্বাধীন রাজ্যের উদ্ভব হয়েছিল। কালক্রমে সমগ্র চট্টগ্রামে এই রাজ্যের প্রসার ঘটেছিল। প্রাচীন বাংলার এই বিস্তৃত ও সমৃদ্ধিশালী রাজ্য সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান এতই সীমিত ছিল যে রাজ্যটি সম্বন্ধে বিস্তারিত কিছু আলোচনা হয় নাই। এমন কি, বহুদিন পর্যন্ত রাজ্যটির অবস্থান সম্বন্ধেও পণ্ডিতবর্গ নিশ্চিত হতে পারেন নি। কিন্তু অতি সাম্প্রতিক কালে এ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। হরিকেল রাজ্যের ইতিহাসের বেশ কিছু নূতন উপাদান সংগৃহীত হওয়ার ফলে এই রাজ্যের অবস্থান এবং প্রাচীন ইতিহাস সম্বন্ধে আমরা মোটামুটি একটা ধারণা করতে সক্ষম হয়েছি।
প্রাচীন হরিকেল রাজ্যের তিনটি স্থান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই তিনটি স্থান হলো রাজধানী বর্দ্ধমানপুর, প্রধান বন্দর দেবগ্রাম এবং প্রধান বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র পণ্ডিত বিহার। এই তিনটি স্থান সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করা হয়েছে।
হরিকেল রাজ্য যে একটি সমৃদ্ধিশালী রাজ্য ছিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। শিক্ষা, শিল্প, অর্থনীতি, ব্যবসা বাণিজ্য, জ্ঞানচর্চা ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে হরিকেল রাজ্য প্রাচীন বাংলার একটি অগ্রগামী রাজ্য ছিল। এই বিষয় সমূহের উপরও আলোকপাত করা হয়েছে।
প্রাচীন হরিকেল রাজ্য প্রায় পাঁচশত বৎসর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল। তারপর ইতিহাসের নিয়মে হরিকেল রাজ্যের পতন ঘটে। প্রধানত, বহিঃশত্রুর আক্রমণের ফলে হরিকেল রাজ্য খণ্ডবিখণ্ডিত হয়ে পড়ে। হরিকেল রাজ্যের বিলুপ্ত স্থানে চক্রশালা ও দেবগ্রাম এ দুটি রাজ্যের প্রাধান্য স্থাপিত হয়।
চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম মুসলিম শাসকের দ্বারা বিজিত হলেও মধ্য চট্টগ্রামে ষোড়শ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত মুসলিম অধিকার বিস্তৃত হয় নি। খ্রীস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীতে মধ্য চট্টগ্রাম গৌড় সুলতান, ত্রিপুরা রাজ এবং আরাকানি রাজার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এরূপ পারস্পরিক সংঘর্ষের ফলে যে জনজীবন বিঘ্নিত হয়ে পড়তো তা বলবার অপেক্ষা রাখে না। অবশেষে সুলতান হোসেন শাহ্ কর্তৃক চট্টগ্রাম বিজিত হয়। কিন্তু ত্রিপক্ষীয় সংগ্রাম ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত চলেছিল।
খ্রীস্টীয় ষোড়শ শতাব্দীর শেষার্দ্ধে ও সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে চট্টগ্রামে আরাকানি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু চট্টগ্রামে আরাকানি আধিপত্য কোনরূপ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে নাই। উত্তর চট্টগ্রামকে জনশূন্য করা হয় এবং মধ্য চট্টগ্রামকে পোর্তুগীজ জলদস্যুদের দিয়ে দেওয়া হয়। কেবলমাত্র দক্ষিণ চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অবস্থা স্বাভাবিক ছিল। এরূপ অবস্থা চট্টগ্রামের পক্ষে মোটেই সুখকর ছিল না।
১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম মোগলদের দ্বারা বিজিত হয়। মোগল বিজয়ের ফলে উত্তর চট্টগ্রামে পুনরায় জনবসতি শুরু হয়। মধ্য চট্টগ্রামে পোর্তুগীজদের কার্যকলাপ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
১৭৬০ সালে চট্টগ্রাম ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনভুক্ত হয়। ১৮৬১ সাল পর্যন্ত কোম্পানির শাসন বলবৎ ছিল। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার স্বহস্তে ভারতের শাসনভার গ্রহণ করে। বিদ্রোহ যাতে পুনরায় না ঘটতে পারে ইংরেজ সরকার একের পর এক কঠোর আইন প্রণয়ন করতে থাকে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধে বাঙালীদের মননশীলতার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়। সাধারণভাবে এই পরিবর্তনকে রেনেসাঁস আন্দোলন বলা হয়ে থাকে। শিক্ষা, সাহিত্যচর্চা, সমাজ সংস্কার, সমাজ উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে রেনেসাঁস আন্দোলনের প্রভাব সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়। সমাজের আধুনিকীকরণে রেনেসাঁসের ব্যাপক অবদান রয়েছে।
সামাজিক পরিবর্তনের সাথে সাথে জনগণের রাজনৈতিক সচেতনতা ক্রমশ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। রাজনৈতিক সচেতনতা থেকে জন্মলাভ করে স্বাধীনতা সংগ্রাম। রাজনৈতিক সচেতনতা ও স্বাধীনতা সংগ্রাম উভয় ক্ষেত্রে মধ্য চট্টগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গ্রন্থটি প্রধানত চট্টগ্রামের মধ্যাঞ্চল (কর্ণফুলী নদী ও শংখনদের মধ্যবর্তী ভূভাগ) নিয়ে রচিত হলেও বৃহত্তর চট্টগ্রামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে উপেক্ষা করা হয় নি। প্রাচীন হরিকেল রাজ্যের ইতিহাস আলোচনায় খ্যাতনামা অভিনেতা ও বিশিষ্ট মুদ্রাতাত্ত্বিক স্বর্গীয় বসন্ত চৌধুরীর নিকট আমি বিশেষভাবে ঋণী। আলোচ্য গ্রন্থটি মৎ প্রণীত A History of Chittagong (2 vols.)-এর ভিত্তিতে রচিত। গ্রন্থটি পাঠক সমাজ কর্তৃক গৃহীত হলে পরিশ্রম সার্থক হয়েছে মনে করব।
- সুনীতি ভূষণ কানুনগো, জুলাই ২০১৬, চট্টগ্রাম
সূচিপত্র
- প্রথম খণ্ড (প্রাচীন হরিকেল রাজ্য)
- ১. প্রাক্-হরিকেল রাজ্যের স্থানীয় পরিচিতি
- ২. হরিকেল রাজ্যের ইতিহাসের উপাদান
- ৩. হরিকেল রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থান
- ৪. হরিকেল রাজ্যের রাজনৈতিক ইতিহাস
- ৫. অর্থনীতি ও ব্যবসা বাণিজ্য
- ৬. ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি
- ৭. শিল্প
- ৮. হরিকেল রাজ্যের পতন
- ৯. চক্রশালা ও দেবগ্রাম
- দ্বিতীয় খণ্ড (মধ্যযুগে মধ্য চট্টগ্রাম)
- ১. স্বাধীন সুলতানি আমলে মধ্য চট্টগ্রাম
- ২. আরাকানি শাসনামলে মধ্য চট্টগ্রাম
- ৩. মধ্য চট্টগ্রামে পোর্তুগীজ কার্যকলাপ
- ৪. মোগল শাসনাধীনে মধ্য চট্টগ্রাম
- তৃতীয় খণ্ড (আধুনিক যুগ)
- ১. ইংরেজ শাসনামলে মধ্য চট্টগ্রাম
- ২. ধর্মীয় সম্প্রদায় সমূহ
- ৩. জনজীবন
- ৪. মধ্য চট্টগ্রামে সাহিত্য চর্চা
- ৫. রেনেসাঁস বা নবজাগরণ
- ৬. রাজনীতি
- ৭. ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন
- তথ্যপঞ্জি
::::::::::
প্রাচীন হরিকেল রাজ্য ও মধ্য চট্টগ্রামের ইতিবৃত্ত
সুনীতি ভূষণ কানুনগো
প্রকাশকাল: জুলাই ২০১৬
প্রকাশক : নন্দন বইঘর
প্রচ্ছদ পরিকল্পনা : সুনীতি ভূষণ কানুনগো
অলংকরণ : সুধীর মণ্ডল
মূল্য : ২০০ টাকা
0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম