লেখক পরিচিতি:
ডেল কার্নেগী ১৮৮৮ যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরিতে একটি অস্বচ্ছল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পঁয়ত্রিশ বছর আগে নিউইয়র্কে ডেল কার্নেগী ছিলেন সবচেয়ে অসুখী একজন মানুষ। জীবিকার জন্য তিনি মোটর ট্রাক বিক্রি করতেন। মোটর ট্রাক কিভাবে চলে তিনি তা জানতেন না। এরপর মাত্র ৪৬ বছর বয়সেই তিনি হয়ে ওঠেন জগৎবিখ্যাত।
ডেল কার্নেগী বলেছেন তিনি জীবিকার জন্য যা কাজ করতেন সেটা তিনি করতে ঘৃণা করতেন। তিনি যে কামরায় বাস করতেন সেখানে আরশোলায় ভর্তি ছিলো, এমনকি যেসব রেস্তোরাঁয় খাবার খেতেন সেখানেও তাঁর ঘৃণা করতো। প্রতিদিন রাত্তিরে তিনি প্রচন্ড হতাশা, দারুণ যন্ত্রণা নিয়ে ঘরে আসতেন। আর কলেজের দিনগুলোর কথা ভাবতেন, যখন তিনি স্বপ্ন দেখতেন।যা তাঁর কাছে এখন দুঃস্বপ্ন। এটাই কি জীবন? নিজেকে প্রশ্ন করতেন? তিনি শুধু চাইতেন পড়তে আর কলেজ জীবনে যে বই লিখবার স্বপ্ন দেখতেন তা লিখতে।তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন, যে কাজ তিনি করতে পছন্দ করেন না, তা ছেড়ে দিলে লোকসানের চেয়ে লাভই হবে। তারপর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন,যে কাজ ঘেন্না হয় সেটা ছেড়ে দেব। তারপর ঠিক করলেন, বয়স্কদের শিক্ষা দান করে তিনি জীবিকা নির্বাহ করবেন। তাও রাত্রিকালীন। কারণ এরপর তিনি সারাদিন বই পড়ার সময় পাবেন, আর শিক্ষাক্রম তৈরি করবেন, আর উপন্যাস আর ছোট গল্প লিখবেন। তিনি বলেছিলেন, আমি চাই লেখার জন্য বাঁচতে আর লিখে বাঁচতে। তারপর ভাবলেন বয়স্কদের কি বিষয় শেখাব? তখন তার কলেজ জীবনের কথা চিন্তা করতেই মনে পড়লো আমি জনগণের সামনে বক্তৃতা দেওয়ার যে শিক্ষা পেয়েছি আর অভিজ্ঞতা হয়েছে তা কলেজ জীবনের অন্যান্য শিক্ষার চেয়ে অনেক বেশি।
তারপর তিনি স্বভাবতই কলম্বিয়া আর নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতের ক্লাসে বক্তৃতা দেওয়া শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য শিক্ষক পদে নিয়োগের আবেদন করেন। তবে ওই বিশ্ববিদ্যালয় দুটি জানাল, তাঁরা ডেল কার্নেগীর সাহায্য ছাড়াই চালাতে পারবে। তখন তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। কিন্তু, পরে তিনি তাঁর জন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানান। কারণ ওই বিশ্ববিদ্যালয় দুটি প্রত্যাখ্যান করায় তার অনেক উপকার হয়।
এরপর তিনি ওয়াই এম সি এর রাতের স্কুলে পড়ানো আরম্ভ করলেন। সেখানে তার শিক্ষকতার দ্রুত আর হাতে হাতে ফল দেখাতে হতো। এরা তাঁর জন্য একটা পরীক্ষাও বটে। কারণ যে বয়স্কদের তিনি শিক্ষা দিতেন তারা ক্লাসে কলেজ শিক্ষা আর সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে আসতেন না। তাঁরা একটা কারণেই আসতেন, তাদের সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা করতে। আর তারা চাইতেন যোগ্যতা নিয়ে নিজের পায়ে দাড়িয়ে স্বাবলম্বী হতে। যাতে কোনো ব্যবসা সংক্রান্ত সভায় দুটো কথা বলতে পারেন। সেলসম্যান রা চাইতেন দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাস যাতে তারা ক্রেতাদের সামনে কথা বলতে পারেন। ব্যবসার উন্নতি আর বেশি টাকা রোজগার করতে। ছাত্ররা কিস্তিতে মাইনে দিতেন, ফল না পেলেই সেটা বন্ধ করে দিতেন। আর তাঁরও নিজের নিয়মিত মাইনের কোন ব্যবস্থা ছিলো না। ছিলো কেবল লাভের কিছু অংশ।
অতএব, বাঁচার জন্য তাঁকে শিক্ষাদানের সময় বক্তৃতার ব্যবহারিক দিকটা নিয়ে সর্তক থাকতে হত। প্রতিটি শিক্ষাক্রমে এমন অনুপ্রেরণা দিতে হতো যাতে তাঁরা আবার আসে। কাজটা বেশ উত্তেজনার ছিলো এবং তিনি ভালোও বাসতেন। তাঁরপর তিনি নিজেই তাজ্জব হয়ে যান, তিনটে শিক্ষাক্রমের মধ্যে যে ওয়াই এম সি তাঁকে প্রতি রাতে পাঁচ ডলারের বেশি দিতে চায়নি তাঁরাই তাঁকে ত্রিশ ডলার করে দিতে শুরু করলেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে বিরাট অংশই ছিলেন ব্যবসায়ী, উচ্চ পদের কর্মী, সেলসম্যান, একাউন্ট্যান্ট, ইন্জিনিয়ার মেয়েদের মধ্যে ব্যবসা করতেন, অনেকে ঘরকন্না। তাদের প্রত্যেকেরই ছিলো নানা দুশ্চিন্তার সমস্যা। তখন তিনি ভাবলেন, দুশ্চিন্তা সম্পর্কে একটি বই দরকার যা তাদের দুশ্চিন্তা দূর করার পথ বাতলে দেয়। তিনি নিউইয়র্কের ফিফ্থ এভিনিউ পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে খোঁজ করতেই দেখলেন, সেখানে দুশ্চিন্তা সম্পর্কে মাত্র ২২ খানা বই আছে। অথচ কীট সম্পর্কে রয়েছে ৮৯ খানা বই একেবারে ৯ গুণ বেশি। লাইব্রেরির তাকে রাখা ২২ খানা বই নিয়ে নাড়াচাড়া করলেন। এছাড়া কিছু বইও কিনলেন। কিন্তু বয়স্কদের ক্লাসে লাগানো যায় এমন একখানাও বই পেলেন না। তখন তিনি ঠিক করলেন নিজেই একখানা বই লিখবেন। কনফুসিয়াস থেকে চার্চিল পর্যন্ত শত শত জীবনী পড়লেন। এছাড়াও নানা রকমের মানুষের সাক্ষাৎকার নিলেন, জ্যাক ডেম্পসি, ওমার ব্রাডলি, মার্ক ক্লার্ক, হেনরি ফোর্ড, এলিনর রুজভেল্ট ও ডরোথি ডিস্ক। তারপর তিনি দুশ্চিন্তা দূর করার বিভিন্ন নিয়ম তার ছাত্রদের উপর প্রয়োগ করেন এবং তার ফলাফল ক্লাসে বলতে বলেন। এটা তাঁর এক ধরনের গবেষণা পদ্ধতি ছিলো। এছাড়াও ডাকে পাঠানো অনেক মানুষের দুশ্চিন্তা জয়ের গল্পও পেতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত তিনি “দুশ্চিন্তা কি করে জয় করলাম” বিষয়ে যেসকল পদ্ধতি বের করেন সেসবের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আমেরিকায় ১০৭৭ টি ক্লাসে আরও ৪৫ টি অন্য রাষ্ট্রে পুরস্কার পায়। তাঁর সেই বইয়ে, হাজার হাজার বয়স্ক মানুষ তাদের দুশ্চিন্তা কিভাবে জয় করেছেন সে কথাই বলা হয়েছে। এই বইয়ে যে সব ব্যক্তিত্বের নাম দেয়া রয়েছে তা মনগড়া নয়।তবে লেখক বলেছেন, এতে নতুন কিছু নেই কিন্তু যা পাবেন তা আগে কাজে লাগানো যায়নি। আনন্দময় জীবন কাটানোর পথ জানানো হয়েছে। তিনি বলেছেন আমাদের অসুবিধা অজ্ঞতা নয়, বরং নিস্ক্রিয়তা। তারপর তিনি এও বলেছেন, দয়া করে এ বইটির প্রথম বেশকিছু পাতা পড়ে ফেলুন-তারপর যদি দেখেন আপনার মধ্যে দুশ্চিন্তা দূর করে নতুন জীবন যাপনের জন্য কোনো শক্তি বা প্রেরণার জন্ম হয়নি তাহলে বইটা ছাই গাদায় ছুড়ে ফেলে দিন। মনে করবেন এ বই তবে আপনার জন্য লেখা হয়নি।
১. আজকের জন্য বাঁচুন।
তিনি বলেছেন, অবশ্যই কালকের চিন্তা করবেন, কালকের জন্য সাবধানে পরিকল্পনাও করবেন।তবে কোনো দুশ্চিন্তা নয়। তিনি দুশ্চিন্তা নিয়ে গবেষণা করার সময় বেশ কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার নেন। তাঁদের মধ্যে.......
হোয়াইট কুইন বলেন: গতকাল আর আগামীকালের রুটিতে মিষ্টি মাখান, কখনোই আজকের রুটিতে নয়। আমরাও বেশিরভাগ এরকম গতকাল আর আগামীকালের রুটিতে মিষ্টি মাখানোর কথা চিন্তা করি। অথচ আজকের রুটিতে পুরু করে তা মাখাতে ভুলে যাই। দান্তে -ভেবে দেখ, আজকের দিন আর আসবে না। জীবন দ্রুত এগিয়ে চলেছে অসম্ভব গতিতে, প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৯ মাইল। আজকের দিন তাই আমাদের অশেষ মূল্যবান সম্পত্তি।
এডওয়ার্ড ইভান্স-ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন হন। বন্ধুকে টাকা ধার দিয়ে দেউলিয়া হয়ে যান। দুশ্চিন্তায় খাওয়া ছেড়ে দেন ঘুমোতে পারেন না। আমার ডাক্তার জানালেন আমি আর ২ সপ্তাহ বাঁচব। দারুণ আঘাত পেলাম। নিজের উইল তৈরি করলাম। তারপর ভাবলাম আর দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই, চুপচাপ দিন গুনতে লাগলাম। মন হালকা করে ঘুমোলাম। আগে সপ্তাহের পর সপ্তাহ টানা ২ ঘন্টাও ঘুমাইনি। আর এখন শিশুর মতো ঘুমোলাম। আমার সব ক্লান্তি কোথায় চলে গেল। খিদে হল, ওজন বাড়তে লাগলো। কয়েক সপ্তাহ পর ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে পারলাম। ছয় সপ্তাহ পর কাজে যোগ দিলাম। বছরে বিশ হাজার ডলার পেতাম এখন সপ্তাহে যে ত্রিশ ডলার পেলাম তাতেই খুশি হলাম। তারপর শিক্ষা পেলাম আর দুশ্চিন্তা নয়, অতীত নিয়ে ভাবনা নয় যা গেছে তার জন্য দুঃখ একেবারে নয়।
বুদ্ধিমান মানুষের কাছে প্রতিটি দিনই নতুন জীবন।
২. দুশ্চিন্তা কাটানোর ইন্দ্রজাল-
- নিজেকে প্রশ্ন করুন সবচেয়ে খারাপ কি হতে পারে??
- অবশ্যম্ভাবী যা, তা গ্রহণ করতে তৈরি হোন।
- তারপর শান্ত ভাবে চেষ্টা করুন খারাপ অবস্থা থেকে কীভাবে উন্নতি করা যায়।
৩. দুশ্চিন্তা আপনার কতখানি ক্ষতি করতে পারে তা ভাবুন।
ড: অ্যালেক্সিস ক্যারেল - যে ব্যবসায়ীরা জানে না দুশ্চিন্তা কী করে জয় করতে হয় তাদের অল্প বয়সেই মৃত্যু হয়।
- চীনের নিষ্ঠুর সেনাধ্যক্ষ তাদের বন্দীদের উপর অত্যাচার চালাতে তাদের খুটির সঙ্গে হাত পা বেধে উপরে ঝোলানো চামড়ার ব্যাগ ভর্তি জলের নিচে রাখতেন। ওই ব্যাগ থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল ঝরে পড়ত মাথায়। অনবরত সারাদিন- রাত ধরে। ওই জলের ফোঁটাকে শেষ অব্দি মনে হতো যেন হাতুড়ির আঘাত মানুষ তাতে পাগল হয়ে যেতো। দুশ্চিন্তাও অনেকটা এই অনবরত ঝরে পড়া জলের ফোঁটার মতো আর ক্রমাগত এই দুশ্চিন্তায় মানুষ উন্মাদ হয়ে যায়।
৪. দুশ্চিন্তা সমাধানের পথ-
রাডিয়ার্ড কিপলিং- আমার ছ'জন সৎ কর্মচারী আছে -তাদের নাম হল, কি, কেন, কখন, কে, কেমন করে আর কোথায়।
- পরিষ্কার লিখে ফেলা কিজন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে।
- কি করতে পারি তা লিখে ফেলা।
- কি করবো ঠিক করে ফেলা।
- সিদ্ধান্তটি সঙ্গে সঙ্গে কাজে লাগানো।
৫. অনিদ্রার প্রতিকার-
- যদি ঘুম না আসে উঠে বই পড়ুন বা কাজ করুন যতক্ষণ না আপনার ঘুম পায়।
- ঘুমের অভাবে কেউ মারা যায়নি। অনিদ্রা নিয়ে দুশ্চিন্তাই অনিদ্রার বেশি ক্ষতি করে।
- প্রার্থনার চেষ্টা করুন।
- শরীরকে সহজ করুন।
- ব্যায়াম করুন।

0 মন্তব্যসমূহ
মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম