“ভিটামিন বিষয়ে আমরা যেভাবে জানলাম” তার বর্ণনা দিলেন ‘আইজ্যাক আসিমভ’

“ভিটামিন বিষয়ে আমরা যেভাবে জানলাম” তার বর্ণনা দিলেন ‘আইজ্যাক আসিমভ’

১০০ বৎসর আগেও সব ধরণের ভিটামিন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ অজ্ঞাত ছিল। কোন নির্দিষ্ট ভিটামিনের অভাবে বিশেষ ধরণের রোগ হলে দুর্ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না। তবে খাদ্যের সাথে ভিটামিনের যে একটা সম্পর্ক আছে তা কিছু কিছু মানুষ মধ্যযুগেই বুঝতে পেরেছিল। কয়েকশত বৎসরের কৌতুহল ও অন্বেষণ একটি যথার্থ রূপ পেতে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ভিটামিন আবিষ্কারের এই রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা আকর্ষণীয় ভাষায় গল্পের মত করে বর্ণনা করা হয়েছে ‘আইজ্যাক আসিমভ’ রচিত “ভিটামিন বিষয়ে আমরা যেভাবে জানলাম” বইতে। যার বাংলায় রূপান্তর করেছেন ‘আবুল বাসার’

বইয়ের সূচিপত্রটি আগে একটু দেখে নেই। পাঁচটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত বইয়ের আলোচ্য বিষয়গুলো নিম্নরূপঃ

  • রোগ ও খাবার
  • প্রথম ভিটামিন
  • আরও ভিটামিন
  • কো-এনজাইম ও ভিটামিন
  • ভিটামিন ও মানুষ

'রোগ ও খাবার' অধ্যায়টি মূলত মানুষের ভিটামিন সম্পর্কে আগ্রহ ও সচেতনতার ইতিহাস। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের কাহিনী আমরা কমবেশি জানি। বইটি শুরু হয়েছে এই ঘটনার উল্লেখ করে। সে সময়ে জাহাজের নাবিকদের মধ্যে স্কার্ভি (Scurvy)  রোগের প্রাদুর্ভাব ছিল। সৈন্যরাও এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেত। কোন সেনাকর্মকর্তার অবশ্য এই রোগ হত না। কারণ তাদের খাদ্যের মেনু ভিন্ন ছিল। ১৭৩৭ সালে জে. জি. ক্রেমার নামে একজন চিকিৎসক বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেন এবং খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন আনার জন্য সেনাবাহিনীকে প্রস্তাব দেন। কিন্তু অখ্যাত একজন চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণ সেনা কর্মকর্তারা গ্রহণ করেন নি।

পরে ১৭৪৭ সালে জেমস লিন্ড নামের একজন স্কটিশ চিকিৎসক ড. ক্রেমার এর দেয়া প্রস্তাবটিকে রীতিমতো প্রমাণ করে দেখান। তিনি বিষয়টি ব্রিটিশ নৌ-বাহিনীকে জানান। কিন্তু জেমস লিন্ড এর প্রস্তাব ব্রিটিশ নৌবাহিনী গ্রহণ করেনি।

জেমস লিন্ডের পরামর্শ খুবই অদ্ভুত আর মনগড়া বলে মনে হয়েছিল নৌকর্তৃপক্ষের কাছে। পৃষ্ঠা- ১৭

আসলে সে সময় ভিটামিন সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোন বৈজ্ঞানিক তথ্য কারও কাছে ছিল না। উপর্যুক্ত বিজ্ঞানী দুজন শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সরকারি কর্তৃপক্ষ নতুন মতামতকে মূল্যায়ন না করলেও প্রখ্যাত ব্রিটিশ অভিযাত্রী জেমস কুক বিষয়টির গুরুত্ব বুঝেছিলেন। ১৭৭০ সালে সমুদ্র অভিযাত্রায় তিনি জেমস লিন্ড এর পরামর্শ মেনে নিজ জাহাজের নাবিকদের খাবার দিয়েছেন। জেমস লিন্ড এর ধারণা যে সঠিক ছিল, তা নিজের নাবিকদলের প্রাণ বাঁচিয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন। সরকারিভাবে এই মতবাদ গ্রহণ করতে আরও সময় লেগেছিল। ১৭৯৫ সালে ব্রিটিশ সরকার খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন এনে ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধরত সৈন্যদের স্কার্ভি রোগের প্রকোপ থেকে নিরাপদ রাখতে পেরেছিলেন।

প্রায় ১০০ বৎসর পর জাপানী নৌবাহিনী একই সমস্যায় পড়েছিল। ১৮৭৮ সালের পরের দিকে জাপানী অ্যাডমিরাল কে. তাকাকি তার সেনাবাহিনীতে মহামারী আকারে হওয়া বেরিবেরি (Beriberi) রোগের সমাধানে ব্রিটিশদের মত খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন করেছিলেন। ফলাফল পাওয়া গিয়েছিল হাতেনাতে। কিন্তু এসব রোগের সাথে খাবারের সরাসরি কি সম্পর্ক রয়েছে, তা কেউই জানত না। অপরিণত বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নিয়ে আসলে তা সম্ভবও ছিল না।

‘প্রথম ভিটামিন’ অধ্যায়ে কীভাবে মানুষের সামনে ভিটামিনের ধারণাটি অবয়ব লাভ করে তার বিবরণ রয়েছে। ১৮০০ সাল থেকে রসায়নবিদগণ কি কি উপাদান দিয়ে খাদ্য তৈরি তা বোঝার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এর আগে থেকেই মানুষ জানতো জীবাণুর কথা (পড়ুন ‘আইজ্যাক আসিমভ’ এর বই “জীবাণু বিষয়ে আমরা যেভাবে জানলাম”) ফলে গবেষণারত প্রত্যেকেই রোগের পিছনে কোন জীবাণু বা বিষাক্ত পদার্থকে দায়ী করত। কোন নির্দিষ্ট ধরণের খাদ্য উপাদানের অভাবে যে কোন রোগ হতে পারে তা কেউ ভাবতে চাইত না।

১৯০১ সালে নেদারল্যান্ডের চিকিৎসক গেররিট গ্রিঞ্জ ভিটামিন বিষয়ক ধারণাটি স্পষ্ট করে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেনঃ-

মানবদেহ অনেকটা যন্ত্রের মত। যন্ত্রের বিভিন্ন অংশ পরস্পরের সাথে মসৃণভাবে চালানোর জন্য কিছু তেলের ফোটা দরকারী। কিন্তু এই সামান্য কয়েক ফোটা তেলও না দেয়া হলে যন্ত্রের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ঘর্ষণ আর শব্দ হতে শুরু করে। এর কারণ এই নয় যে, যন্ত্রের মধ্যে কোন ক্ষতিকর কিছু যোগ করা হয়েছে। বরং এর কারণ প্রয়োজনীয় কোন কিছু একটা যন্ত্রে দেয়াই হয়নি। পৃষ্ঠা -২৫

এর কিছুদিন পরে ১৯০৬ সালে ইংরেজ রসায়নবিদ ফ্রেডরিক গোল্যান্ড হপকিন্স এক বিজ্ঞান সম্মেলনে বলেনঃ-

খাদ্যের মধ্যে সম্ভবত অনেকগুলো উপাদান খুবই অল্প পরিমাণে উপস্থিত থাকে। কিন্তু মানবদেহ এই উপাদানগুলো নিজে নিজে তৈরি করতে পারে না। বরং খাবার থেকে এ উপাদানগুলো পূর্বপ্রস্তুত অবস্থায় গ্রহণ করে দেহ। কিন্তু এই উপাদানগুলো সামান্য পরিমাণেও যদি না পাওয়া যায় তবেই ফলাফল হিসেবে দেহে রোগ দেখা দেয়। পৃষ্ঠা - ২৬

হপকিন্স ছিলেন একজন নামকরা প্রভাবশালী রসায়নবিদ। তার কথা সকলেই গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছিল। তার বক্তব্যের স্বপক্ষে এবং বিপক্ষে প্রমাণ খুঁজতে গিয়ে একে একে বিভিন্ন ভিটামিন, তাদের পরিচয়, বৈশিষ্ট্য, পারমাণবিক গঠন ইত্যাদি আবিষ্কার হতে থাকে। নানারকম ভুলভ্রান্তি সংশোধন করে ১৯৩৭ সালে ভিটামিন বিষয়ক গবেষণা মোটামুটি একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়। আজ মানবজাতি খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিনের প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব এবং উৎস সম্পর্কে সচেতন হতে পেরেছে এই অক্লান্ত পরিশ্রমী বিজ্ঞানীদের কারণেই।

আলোচ্য বইটি বাংলায় রূপান্তর করেছেন ‘আবুল বাসার’। তার ভাষা সরল ঝরঝরে। অল্প বয়সী শিশু-কিশোর পাঠকের কথা মাথায় রেখে রচিত বইয়ের কোথাও কোন জটিল শব্দ বা বাক্যবন্ধ নেই। ঘটনাগুলোর বর্ণনাভঙ্গি এত আকর্ষণীয় যে নবীন পাঠক আনন্দের সাথে বইয়ের পাতাগুলো উল্টাতে থাকবে। শুধু অল্প বয়সীরা নয়, বড়রাও এই বই থেকে স্বল্প আয়াস ও সময়ে ভিটামিন আবিষ্কারের কাহিনী জানতে পারবে। বইয়ের প্রথমে সংক্ষেপে প্রখ্যাত বিজ্ঞান কল্পকাহিনী লেখক আইজ্যাক আসিমভ সম্পর্কে একটুখানি পরিচিতি রয়েছে। লেখককে চিনতে এই অংশটি সহায়ক হবে।

বাংলাভাষাী শিশু-কিশোরদের জন্য জ্ঞানবিজ্ঞানের বইয়ের খুব অভাব। এই খরা দূরীকরণে আবুল বাসারের অবদান কৃতজ্ঞতার সাথেই উল্লেখ করা দরকার। জ্ঞানার্জনে উৎসাহী সকল পাঠকের কাছে এই বই পৌঁছাক এই প্রত্যাশা করি।

আমার হাতে যে বইটি রয়েছে তার প্রিন্টার্স লাইন যে পাতায় থাকে (শিরোনাম পৃষ্ঠার পরের পৃষ্ঠা), সেই পাতাটি নেই। বাঁধাইয়ের সময় অসাবধানতার কারণে এরকমটা হতে পারে। ফলে বইয়ের প্রচ্ছদশিল্পী, ISBN নাম্বার দেয়া গেল না। বিভিন্ন পাতা ও শেষ প্রচ্ছদে যে কয়েকটি তথ্য পাওয়া গেল, তাই নিচে উল্লেখ করলাম। প্রচ্ছদে লেখা আছে বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণের কথা। প্রত্যাশা করি তৃতীয় মুদ্রণে বিষয়টির প্রতি বিশেষভাবে মনোযোগ দেয়া হবে।

-#-#-#-#-#-#-#-#-#-#-
ভিটামিন বিষয়ে আমরা যেভাবে জানলাম
আইজ্যাক আসিমভ

রূপান্তরঃ আবুল বাসার
প্রকাশকঃ প্রকৃতি পরিচয়, ঢাকা।
প্রকাশকালঃ ২০১৭
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ৫৬
মূল্যঃ একশত টাকা


# আইজাক আসিমভ রচিত আরও দুইটি বই সম্পর্কে পড়ুনঃ
# চিকিৎসা বিজ্ঞানের কয়েকটি আবিষ্কার ও নানারকম ভাইরাস সম্পর্কে জানতে পড়তে পারেনঃ

মতামত:_

0 মন্তব্যসমূহ