‍সখিচান এবং বাঘের ঘরে ঘোগ: সেলিম মোরশেদের গল্প প্রসঙ্গে - আহসান হাবিব

‍সখিচান এবং বাঘের ঘরে ঘোগ: সেলিম মোরশেদের গল্প প্রসঙ্গে - আহসান হাবিব

*

বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প 'সখিচান' পড়ে উঠলাম। গল্পটি তথাকথিত নিম্নবর্গের মানুষদের নিয়ে কিন্তু এর সত্যটা মানবপ্রজাতির অস্তিত্বের মূলের সংগে জড়িত। এটি একই সঙ্গে প্রাগৈতিহাসিক এবং আধুনিক সকল যুগের জন্য সত্য। লেখকের কাজ এই সত্যকেই দেখানো। সেলিম মোরশেদ তা দেখিয়েছেন এমন দক্ষতায় যার তুলনা পাওয়া সহসা ভার। তার বাক্যগঠন এবং শব্দচয়ন মুহূর্তকে মহাকালিক করে তোলে। পাঠ শেষে আমাদের বোধটি ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ হয়ে ওঠে।

গোবিন্দের প্রাকৃতিক হত্যার ভেতর দিয়ে সখিচানের ক্রুর প্রতিরোধস্পৃহাকে আর নৃশংস মনে হয় না, মনে হয় এটাই নায্য। কেননা গোবিন্দ তার ভেতরে এই স্পৃহা বুনে দিয়েছে তার দিক থেকে প্রজাতিগত বৈশিষ্ট্যের আচরণ দিয়ে যা স্বার্থের দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে ন্যায়ত। এই দ্বন্দ্বই মানবপ্রজাতির জার্নির এক অমোঘ সত্য। সেখানে নৈতিকতা কিংবা মানবতা কেবল আরোপন ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। যদিও মানুষের অন্বিষ্ট সেটাই।

'সখিচান' একবার পড়লে কিছুই বোঝা যায় না। সঘন অভিনিবেশ ছাড়া সেলিম মোরশেদের কোন গল্পই বোধের আওতাভুক্ত হয় না। শুধু সখিচান নয়, এই সত্যটি তার যে কোন গল্প কিংবা লেখা সম্পর্কে সত্য। তার চিন্তার অনন্যতার একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিষয়কে গভীরভাবে দেখা। এই দেখার চোখটি একজন বিজ্ঞানীর মত। একজন বিজ্ঞানী যেমন একটি বস্তুর সত্যকে তুলে আনেন নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে, একজন লেখকও সামাজিক সত্যকে তুলে আনার জন্য তাই করেন। তাকে ডুবে যেতে হয় সামাজিক ইতিহাসের গভীরে একজন ডুবুরীর মত।

সেলিম মোরশেদ সেই সমাজবিজ্ঞানী যিনি তার প্রতিটি লেখায় একটি সত্য তুলে আনেন যা তার দর্শনের অনুগামী। কি তার দর্শন? আর কিছু নয় সেটি অব্যর্থ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শন। কারণ এই দর্শন এবং মেথোড ছাড়া কোন সত্যের দেখা মেলে না।

* ১ *

আমরা যদি সখিচান মুলতবি রেখে তার গল্পগ্রন্থ 'বাঘের ঘরে ঘোগ' এর দিকে চোখ ফেলি, তার দার্শনিক প্রত্যয়টিকে বাঙ্ময় হয়ে ফুটে উঠতে দেখবো। প্রতিটি গল্পেই তিনি বস্তুবাদী দর্শনের ভিত্তিতে ইতিহাস, ব্যক্তি এবং ঘটনাকে শিল্পায়িত করেন।

এপ্রসঙ্গে আমরা যদি সামাজিক বিকাশের ইতিহাস লক্ষ্য করি, দেখবো যে পর্বগুলি পেরিয়ে এসেছে মানুষ, তার প্রতিটি করেছে সেই সমাজের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা শোষিত শ্রেণি। মানুষ যেদিন থেকে সমাজবদ্ধ হয়েছে, শ্রেণি গড়ে উঠেছে। এর একদিকে থেকেছে আধিপত্যবাদী, বিপরীতে অধঃপতিত। আধুনিক ভাষায় যদি বলি তাহলে বলি শোষক এবং শোষিত। দেখা গেছে শোষক শ্রেণিটা সংখ্যায় খুব কম কিন্তু উৎপাদনের হাল হাতিয়ার যেহেতু এদের দখলে থাকে, তাই তারাই শাসন করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে। কিন্তু সমাজবিকাশের সংগে সংগে এই সম্পর্কটা টিকে থাকার শর্ত হারিয়ে ফেলতে থাকে, তখন এর মীমাংসার ভার পড়ে অগ্রশীল শ্রেণির উপর। এই বাহিনী সচেতন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পুরনো ব্যবস্থাকে রূপান্তর করে পরের উচ্চতর বিকশিত সমাজে। বিকশিত কিন্তু নতুন করে আবার সে দ্বন্দ্বে জড়ায়। আর দ্বন্দ্ব মানেই  দুই বিপরীতের সহাবস্থান।

পুরনো সমাজ ছাড়িয়ে আমরা যদি বিদ্যমান সমাজকে দেখি, দেখবো এই পুঁজিবাদী সমাজ যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সামন্তবাদকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে মানুষ। ভূমি দাসত্ব থেকে মজুরিদাসত্বে পরিণত হওয়া একদল আর একদল পুঁজিপতি বা বুর্জোয়া। এই রূপান্তর এমনি এমনি হয়নি, হয়েছে রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। ইতিহাসে এই বিপ্লবের নাম বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এই বিপ্লব ছিল সবচেয়ে প্রগতিশীল কাজ এবং এর সংগে জড়িত রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী এবং দার্শনিকগণ যে ভূমিকা পালন করেন, তা অতুলনীয়।

কিন্তু বিপ্লবের পর মানুষ আবার আগেই বললাম মজুরি দাসত্বে বন্দী হয়ে পড়লো। এই সময় একজন লেখক কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হলে তাকে প্রগতিশীল বলে অভিহিত করা যাবে?

যে কোন ধরণের বন্দীত্ব থেকে মুক্তি যদি প্রগতিশীলতার প্রধান সূচক হয়, তাহলে এই নব প্রতিষ্ঠিত বুর্জোয়া ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াই হবে তার সাহিত্যিক তৎপরতা। সমাজের শোষিত শ্রেণির সাংস্কৃতিক রূপায়নই হবে তার শৈল্পিক দায়।

কিন্তু যদি একজন সাহিত্যিক সমাজ বিকাশের বিজ্ঞান না বোঝেন, তাহলে চলমান রাজনীতির কৌশল এবং কর্মসূচির যাথার্থ্য বুঝে উঠতে পারবেন না। এই ক্ষেত্রে আমাদের সেলিম মোরশেদ ব্যতিক্রম। তিনি সমাজ বিকাশের বিজ্ঞান শুধু নয়, এর রূপান্তরের যে শিল্প যা বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়, তার বিজ্ঞানও জানেন। কি করে বুঝলাম?

তার গল্প পড়ে। 'বাঘের ঘরে ঘোগ' গল্পগ্রন্থের প্রতিটি গল্প এই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, বিপ্লবী দর্শন এবং রণকৌশলের প্রতিটি পদক্ষেপ তার বোধের আয়ত্তাধীন। এই বইয়ের প্রথম গল্প 'রক্তে যত চিহ্ন' যদি পাঠ করি দেখবো বিশু নামের একজন সমাজবিপ্লবীকে রাষ্ট্রের পুলিশবাহিনী গ্রেফতার করে অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে। তারা চেষ্টা করছে তার কাছ থেকে তার দলের লোকজন এবং অস্ত্রশস্ত্রের খোঁজ সম্পর্কে। কিন্তু অমানবিক নির্যাতনের মুখেও সে কোন তথ্য দিচ্ছে না। এই নৈতিকতা তার দলীয় কিন্তু বিপ্লবের পথ সম্পর্কে তার অনেক প্রশ্ন আছে। সে তার পার্টির যে পথ- শ্রেণিশত্রু খতম- তার সঙ্গে একমত নয়। কিন্তু পার্টিতেও সে এই প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারে না। করলেই সে জানে তার বিরুদ্ধে সংশোধনবাদী আখ্যা দিয়ে তাকে সরিয়ে দেবে। সে অচিরেই দেখতে পায় শ্রেণিশত্রু খতমের রাজনীতির পথ অবৈজ্ঞানিক এবং তা স্রেফ ব্যক্তিগত শত্রুতায় পরিণত হয়েছে। কার্ল মার্ক্স এদের সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন -

 

'শ্রেণি-সংগ্রামের সুনির্দিষ্ট অবস্থার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ নয়, তার জায়গায় তারা বসাতে চাইছে নিজেদের বিষয়ীগত ইচ্ছা এবং সংগঠিত গণআন্দোলনের পরিবর্তে চকিত আক্রমণপন্থী ধ্যানধারণা।'


মার্ক্সবাদ এই হঠকারী রাজনীতিকে প্রত্যাখান করেছে প্রথম থেকেই। কমিউনিস্ট লীগ এবং প্রথম আন্তর্জাতিক থেকেই এই সংশোধনবাদী পেটিবুর্জোয়া রোম্যান্টিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে। লেনিনকে করতে হয়েছে, মাও সেতুঙকে করতে হয়েছে। কিন্তু এই শিক্ষা ভারতবর্ষের কমিউনিস্টরা গ্রহণ করেনি। এখানে দুই ধরণের সমস্যা এবং বিভ্রান্তি দেখা যায়। এক হচ্ছে শ্রেণীশত্রু খতমের হঠকারিতা অন্যটি হচ্ছে পেটিবুর্জোয়া দর্শনের ভিত্তিতে রণকৌশল গ্রহণ। দুটোই পরিতাজ্য। ফলে সময়ের ব্যবধানে আজ এটা স্পষ্ট যে দুটি পথই ভুল এবং আজ তারা বিলুপ্তিতে পর্যবেশিত।

সেলিম মোরশেদ দর্শনের এই জায়গাটি বোঝেন এবং তার সমালোচনা বিশু চরিত্রের ভেতর দিয়ে তুলে ধরেন। বিশুর আত্মত্যাগ একদিকে প্রমাণ করে বিপ্লব সত্য কিন্তু পথ ভুল। তিনি ভুল পথ থেকে শিক্ষা নিতে এই গল্পের মধ্য দিয়ে আহ্বান রাখেন যা তার প্রগতিশীল ভূমিকাকে উর্ধ্বে তুলে ধরে।

* ২ *

'বাঘের ঘরে ঘোগ' বইটির দ্বিতীয় গল্প 'মৃগনাভি'। আমার বিবেচনায় এই গল্পটি বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে অনন্য এবং গল্পটি নির্মেদ ও আবেগবর্জিত এক শিল্পরূপের প্রতীক হিসেবে স্থান পাওয়ার যোগ্য।

পুঁজিবাদ শুধু যে প্রান্তিক দুই শ্রেণি তৈরি করে তা নয়, সে তৈরি করে নানা অনুৎপাদনশীল বর্গ। এরা পুঁজিপতিদের  উদ্বৃত্তমূল্যে ভাগ বসায়। এদের একটি হলো মাফিয়া চক্র। এই চক্র কোন উৎপাদনে অংশগ্রহণ করে না, তথাপি তারা হয়ে ওঠে নিয়ন্ত্রক। তাদের প্রধান শক্তি হয়ে দাঁড়ায় অস্ত্র এবং হত্যার হুমকি।

বিকাশ এবং জোসেফ এই দুটি চরিত্র বাংলাদেশে খুবই পরিচিত। মৃগনাভি গল্পের প্রধান চরিত্র এই দুই মাফিয়া। তারা একদা যে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল, বাংলাদেশের মানুষ তা মনে রাখবে। সেলিম মোরশেদ এই দুই চরিত্রকে যেভাবে চিত্রায়ন করেছেন, তা বিস্ময়কর। খুব কাছে থেকে না দেখলে এইভাবে চিত্রায়ন করা যায় না। আমরা বিস্ময়ে লক্ষ্য করি এই দুই চরিত্র এক একজন ক্ষুরধার ইনটেলেক্ট। তারা নিজেরা যখন বিবিধ বিষয়ে কথা বলে, এমনকি যৌনতা বিষয়ে, তখন তাদের শিল্পময়তা ফুটে ওঠে। কিন্তু বিশেষ নারী সম্পর্কে যখন তারা মতামত দেয়, তাদের মত পরস্পর বিপ্রতীপ হয়ে ওঠে। প্রকৃতপ্রস্তাবে তারা যে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী, বেরিয়ে আসে। 


পুঁজিবাদী সমাজের যে দ্বন্দ্ব, তা এদের মধ্যে ক্রিয়াশীল নয়, তাদের প্রধান দ্বন্দ্ব ভাগবাটোয়ারা কেন্দ্রিক। যখন এই ভাগবাটোয়ারা নিয়ে মতভেদ হয়, তারা একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী রূপটি বেরিয়ে আসে। তাদের সহাবস্থান আপাত বন্ধুত্বের, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বয়ে চলেছে শত্রুতার হিমশীতল স্রোত।

তারা একসঙ্গে কোথাও যায়। যেখানে অপেক্ষা করে তাদের জন্য লুণ্ঠনের ভাগ নিতে। ভাগ নিতে গিয়ে মতানৈক্য হয়, তারা একে অপরকে গুলি করে হত্যা করে।

এই যে পরস্পর হত্যার মধ্য দিয়ে গজিয়ে ওঠা মাফিয়ারা নিজেদের শেষ করে দেয়- এই পরিণতি স্বাভাবিক। কারণ এখানে তাদের মধ্যে পুঁজিপতিদের মত বাজারকেন্দ্রিক সুস্থ প্রতিযোগিতা নেই, আছে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে লুণ্ঠন। আগে আমরা দেখেছি বিশুকে শ্রেণিশত্রু খতমের নামে ব্যক্তিসন্ত্রাস কায়েমের ঘটনায় শেষ হয়ে যেতে। অর্থাৎ নিয়মতান্ত্রিকতার বাইরে কোনকিছু রূপান্তর করা সম্ভব নয়।

মৃগনাভি গল্পের মধ্য দিয়ে লেখক সেলিম মোরশেদ সেই বার্তা পৌঁছে দেন। তিনি সমাজের বিবিধ দ্বন্দ্বের মিমাংসার নিয়মগুলি বৈজ্ঞানিকভাবে জানেন বলে এই ধরণের চরিত্র নির্মাণ এবং তার ফলাফল নির্ভুলভাবে দেখাতে পারেন। আমার পর্যবেক্ষণে এমন লেখক বাংলাদেশে বিরল যিনি সমস্যা বা ঘটনাকে এমন প্রজ্ঞাচোখে দেখতে সক্ষম।

সেলিম মোরশেদ দর্শনের এই জায়গাটি বোঝেন
'পরম্পরা' নামের গল্পটিতেও আমরা সামাজিক বিকাশের একটি রূপের চিত্রায়ন দেখি। এখানে একটি অভিজাত বা সামন্ত সমাজ ভেঙে গেলে নতুন সমাজে তাদের কি পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। সবকিছু ভেঙে পড়ে, কেননা কোনকিছুই আর আগের মত নেই। পরিবারের নতুন প্রজন্ম নতুন পরিস্থিতির সংগে খাপ খাইয়ে নিতে গিয়ে এক একজন এক একরকম হয়ে ওঠে। কারো মধ্যে উচ্ছৃঙ্খলতা দেখা দেয়, কেউ বা সুস্থ চিন্তা করে। পুরনো এবং নবীন সদস্যদের যে বিচিত্র মনস্তত্ত্ব এই গল্পে চিত্রিত হয়েছে, এক কথায় তা দারুণ বাস্তবানুগ। নিজেদের সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব একটা পরিবার নতুন সমাজবাস্তবতায় কিভাবে খাপ খাওয়ায়, তাদের অন্তর্দ্বন্দ্ব, দাহ, মনঃপীড়া ইত্যাদি খুব সূক্ষ্মতায় চিত্রিত হয়েছে। একই কথা বলতে চাই, লেখক যদি সমাজবিকাশের প্রতিটি স্তরে সম্পর্কের ভিত্তিতে মানব মনস্তত্ত্ব কিভাবে বদলে যায়, তার সঠিক রূপ না জানেন, তাহলে সাহিত্য করা যায় না। একজন প্রকৃত সাহিত্যিক সমাজে থেকেও অন্যদের চেয়ে আলাদা হয়ে যান যে কারণে তার অন্যতম প্রধান সূচক হচ্ছে ঘটনাকে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে পারার ক্ষমতা। সেলিম মোরশেদ সেই ক্ষমতার অধিকারী একজন লেখক।

'বাঘের ঘরে ঘোগ' নামের গল্পটিতে শ্রেণিদ্বন্দ্বকে বাঘি এবং মাখন নামের চরিত্রের ভেতর দিয়ে চিত্রিত করেছেন, তা এক কথায় অতুলনীয়। চট করে এটা দেখতে পাওয়া সম্ভব নয় যদি না পাঠক শ্রেণি সম্পর্কে ধারণা রাখেন এবং তা কিভাবে সামাজিকভাবে প্রকাশিত হয়। মাখনের তুলনায় বাঘি সামাজিকভাবে উপরের শ্রেণির। মাখন তাকে পছন্দ করে। তাকে সে পেতে চায়। কিন্তু তার ভেতরে শ্রেণিগত হীনমন্যতা কাজ করে, ফলে সে জোর করে বাঘিকে ভোগ করতে চায়। প্রেম নয়, শরীর ভোগ। মাখনের জোরের কাছে বাঘি পরাজিত হলেও সে তাকে সুযোগ বুঝে ছুরি চালায় এবং এতে মাখনের মৃত্যু ঘটে। সেলিম মোরশেদ এই ঘটনার মধ্য দিয়েও শ্রেণিশত্রু খতমের সন্ত্রাসী পথের ভুলকে ইঙ্গিত করেন। তাছাড়া এই গল্পে বামপন্থার হতাশাকে বিভিন্ন চরিত্রের ভেতর দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে যার মূল কথা হচ্ছে বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজ রূপান্তর কোন হঠকারী বিষয় নয়, বরং ঘটনার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সঠিক রণকৌশল নেয়া এবং লাগাতার সংগ্রাম চালিয়ে তাকে সফল করে তোলা। এজন্য লেনিন বলেছিলেন বিপ্লব একটি শিল্পকর্ম।

* ৩ *

আমরা যদি সখিচান গল্পে ফিরে আসি, দেখবো এখানেও সেলিম মোরশেদের শ্রেণি অবস্থান। তিনি নিম্নবর্গের মানুুষদের সংস্কৃতি রূপায়নের কাজটি করছেন। এখানে দেখছি সখিচান এবং তার পরিবার ও বন্ধুরা বুর্জোয়া সংস্কৃতির বিপরীতে নিম্নবর্গের সংস্কৃতিতে তার চাকুরীজীবনকে সেলিব্রেট করছেন। নিজের বাসায় বসেছে সেই আসর। আসরে এসেছেন একজন কবি, মধ্যবিত্ত, তাও আবার মুসলমান। এই যে একজন মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে আগত একজন কবি যোগ দিয়েছেন আসরে, এটা কিসের ইঙ্গিত? আমার মনে হয়েছে মনোহর নামের এই চরিত্রের মধ্য দিয়ে সমাজে গেঁড়ে থাকা যে জাতপাত তার বিরুদ্ধে একটা অবস্থান। এই অবস্থান জাতপাতহীন এক শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজের ইঙ্গিতবাহী। এটাই লেখক সেলিম মোরশেদের দার্শনিক অবস্থান।

সখিচান গল্পের প্রথমেই শীতের রাতের যে কুহেলিকা তৈরি করা হয়েছে, প্রথমে কুহক মনে হলেও এর নিরসন ঘটে গল্পের শেষে। এই কুহক নির্মাণই গল্পটিকে ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছে। পাখির মুমূর্ষু ডাক, বিদ্যুতের তার, কর্দমাক্ত মাটি, পিছল খু্টি, কুয়াশা সব মিলিয়ে পরিবেশটি ভয়ার্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষত পাখির বাঁচবার আকুতি, গোবিন্দের তাকে বাঁচাবার চেষ্টা, ফাল্গুনির আকুতি সব মিলিয়ে একটা টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।

কিন্তু অচিরেই আমরা বুঝতে পারি এই কুহকই গল্পটিকে মানবপ্রজাতির কর্মের ভবিতব্যকে অনিশ্চয়তার মোড়কে রেখে মানুষকে টেনে নিয়ে যায়। গোবিন্দের মৃত্যুতে সখিচান তার সুপ্ত প্রতিরোধস্পৃহার মিমাংসা হয়। এই গোবিন্দই চাকুরীস্থলে সখিচানের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দিয়ে ডোমের চাকরি থেকে সরিয়ে ঝাড়ুদারে পরিণত করে। সখিচান এই কষ্ট নিয়েই চাকুরীজীবন শেষ করেন। আজ সেই শেষদিন এবং সেলিব্রেশন পার্টি।

এই গল্পে জীবনের নানা সত্য প্রকটিত হয়েছে অসাধারণ দক্ষতায়। রামপিয়ারীর গল্প মানুষের চিরকালিন প্রেম এবং বহুগামিতার সত্যকে দেখায়। সখিচান অজস্র লাশ কেটেও মৃত্যুর দেখা পায় না। তার মতে প্রিয় যা তাকে না পাওয়াই মৃত্যু। এখানে রাসপিয়ারীর প্রতি তার বেদনা ফুটে ওঠে। আর রূপের প্রতি তার ছিল অসাধারণ টান। একটা সদ্য মায়ের বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করা লাশ কাটতে গিয়ে তিনি অঝোরে কাঁদেন। দুলারী, তার স্ত্রী, তার প্রতি আছে মায়া, আর রাসপিয়ারীর প্রতি মোহ। জীবন যেন তার কাছে মায়া এবং মোহের সংমিশ্রণ।

সঘন অভিনিবেশ ছাড়া সেলিম মোরশেদের কোন গল্পই বোধের আওতাভুক্ত হয় না। শুধু সখিচান নয়, এই সত্যটি তার যে কোন গল্প কিংবা লেখা সম্পর্কে সত্য।


সখিচান গল্পে মানবপ্রকৃতির এক অমোঘ সত্য উন্মোচিত হয়েছে এক অননুকরণীয় ভাষিক বুননে। শুধু সখিচান নয়, বাঘের ঘরে ঘোগ গ্রন্থের প্রতিটি গল্পের ভাষাকে আমার মনে হয়েছে ক্ল্যাসিকাল সংগীতের মত। অনুভূতির গভীরতাকে কেবল সংগীতের ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব। সেলিম মোরশেদ সেই কাজটি করেছেন ঈর্ষনীয় দক্ষতায়। কোন কোন বাক্য আমাদের বোধের অতীত থেকে যায়। তখন তার ভাষা কবিতাশ্রয়ী হয়ে ওঠে। সেলিম মোরশেদের গল্পের ভাষায় গদ্য, কবিতা এবং সংগীত জড়াজড়ি করে থাকে।

সেলিম মোরশেদের প্রণিধানযোগ্য বিশেষত্ব হচ্ছে তিনি কোথাও আবেগের আতিশয্য দেখান না। শিল্প যে একটা স্মার্ট নির্মাণ, তার প্রতিটি গল্পে এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। আর তার চরিত্রগুলির শ্রেণিবৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিদ্যমান সমাজকে ভেঙে একটি বৈষম্যহীন সমাজের অগ্রগামী মানুষ। এটাই সেলিম মোরশেদের প্রগতিশীলতার চিহ্ন।

**********

বাঘের ঘরে ঘোগ
সেলিম মোরশেদ


প্রচ্ছদ: জীবন
প্রকাশক: উলুখড় প্রকাশনা, ঢাকা
প্রকাশকাল: ২০০৮
পরিবেশক: র‍্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ৭১
মূল্য: ১০০ টাকা
ISBN: 984-300-001414-8

মতামত:_

1 মন্তব্যসমূহ

মার্জিত মন্তব্য প্রত্যাশিত। নীতিমালা, স্বীকারোক্তি, ই-মেইল ফর্ম